ধর্মের নামে অধর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: প্রজেক্টরের পর্দায় তখন মিরাজ সরদার। গত বছরের এক বিকেলের গল্প বলছেন তিনি। শিক্ষক রিপন চক্রবর্তীকে সবার সামনে ছুরি মেরে পালাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। কে, কী করছেন সেদিকে না তাকিয়ে মিরাজ পিছু নিয়েছেন সন্ত্রাসীদের। খালি হাতে ধরে ফেলেন একজনকে।
রাজধানীর র্যাডিসন ব্লু হোটেল মিলনায়তনে পিনপতন নীরবতার মধ্য দিয়ে মিরাজের এই গল্প বলা শেষ হলো। এর পরপরই দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিরা দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে সম্মান ও অভিনন্দন জানালেন মিরাজকে।
গতকাল বুধবার ফারাজ হোসেন সাহসিকতা পুরস্কার হাতে পেয়ে মিরাজ সরদার বলেন, ‘আমি ধর্ম পালন করি, ধর্ম মানি। কিন্তু ধর্মের নামে অধর্ম মানি না। ধর্মের নামে যাঁরা অধর্ম করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।’
ফারাজ হোসেনের মতো সাহসী তরুণদের এ বছর থেকে পেপসিকো গ্লোবাল প্রতিবছর সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্বীকৃতি সনদের পাশাপাশি পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে ১০ হাজার মার্কিন ডলার। তারই অংশ হিসেবে পুরস্কৃত হলেন মাদারীপুরের মিরাজ সরদার। সরকারি নাজিমউদ্দিন কলেজে ছোটখাটো চাকরি করেন তিনি। আর রিপন চক্রবর্তী ছিলেন ওই কলেজেরই অঙ্কের শিক্ষক।
কেন মিরাজ সরদার—তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পেপসিকো গ্লোবালের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইন্দ্রা কে. নুয়ি ফারাজের সাহসিকতার প্রসঙ্গ টানেন। তিনি বলেন, ফারাজ ছোট্টবেলায় শান্তশিষ্ট ছিলেন। এমনকি তাঁর ভাইয়ের সঙ্গেও ঝগড়া-বিবাদ এড়িয়ে চলতেন। অথচ ১ জুলাই ফারাজ তাঁর সব শক্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। আঁধারের মধ্যে আলো জ্বেলেছিলেন। সেই আলো সবখানে ছড়িয়ে দিতে এই উদ্যোগ।
নুয়ি বলেন, ‘ফারাজের গল্প এখন মানুষের মুখে মুখে। এ গল্প ছড়িয়ে দিতে হবে। এমন আরও অনেক ফারাজকে আমাদের দরকার—বাংলাদেশে, দক্ষিণ এশিয়ায় তথা সারা বিশ্বে।’
ফারাজের নানা ও ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান পেপসিকো গ্লোবালের এই উদ্যোগকে বিনিয়োগ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এই পুরস্কার তরুণদের মধ্যে সাহসিকতার চর্চা বাড়াবে। কারণ, ফারাজই বাংলাদেশ। ফারাজই ধারণ করে বাঙালি মূল্যবোধ।
লতিফুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষকে চেনার যদি কোনো একটি নিয়ামক থেকে থাকে, তা হলো আতিথেয়তা। আমাদের ভেতরকার এই অনুভূতিকে সন্ত্রাসীরা তলোয়ার, ছোরা আর গোলাবারুদ দিয়ে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। হলি আর্টিজান ক্যাফের ভেতরে ফারাজ যখন ওদের মুখোমুখি অসীম সাহসিকতা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তখন নিশ্চয়ই ওদের সন্ত্রাসী মন পরাজিত হয়েছিল।’
লতিফুর রহমান বলেন, ‘আমরা দেখেছি, মানুষ ওই হামলার পর ভয়ে কাতর হয়ে যায়নি। প্রতিটি মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমি সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকারও প্রশংসা করি। প্রথম দিন থেকে তারা “জিরো টলারেন্স” দেখিয়েছে।’
আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের পাশাপাশি ছিল ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণাও। গোটা অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ফারাজের বড় ভাই যারেফ আয়াত হোসেন। যারেফ বলেন, বছর দুয়েক আগে ফারাজ তাঁর ডায়েরিতে নিজের সম্পর্কে যা লিখেছিলেন, ঠিক তাই তিনি করেছেন গুলশানের হলি আর্টিজানে। তিনি ফারাজের ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকে উদ্ধৃতি দেন। ফারাজ লিখেছিলেন, ‘আমি স্বতন্ত্র। আমি কঠিন সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি। আমি আমার প্রতিশ্রুতি রাখতে গিয়ে নিজের আনন্দকে বিসর্জন দিতেও প্রস্তুতছিলাম।’ ফারাজ এখন তাঁর রোল মডেল। আর তাঁদের দুই ভাইয়ের রোল মডেল মা সিমিন হোসেন।
গত সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হোটেলে মিরাজ সরদারের হাতে পুরস্কার তুলে দেন পেপসিকো গ্লোবালের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইন্দ্রা কে. নুয়ি। তাঁর হাতে সনদ তুলে দেন জুরিবোর্ডের আহ্বায়ক ও ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ফারাজের নানা ও ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান এবং ফারাজের মা সিমিন হোসেন এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে জুরিবোর্ডের চেয়ারম্যান স্যার ফজলে হাসান আবেদ বলেন, ই-মেইল ও টেলিফোনে প্রায় ৫০০ তরুণের নাম আসে জুরিবোর্ডের কাছে। তাঁদের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচন করা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে জুরিবোর্ডের সদস্যদের মধ্যে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবরার আনোয়ার, পেপসিকো বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার মনিষ মুলে, ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষক সাবাহাত জাহান উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, প্রখ্যাত অভিনেত্রী শাবানা আজমি ও চলচ্চিত্র পরিচালক মহেশ ভাট, সাংসদ মঈন উদ্দীন খান বাদল, পেপসিকোর এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা অঞ্চলের নির্বাহী প্রধান সঞ্জীব চাড্ডা, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, আইয়ুব কাদরী, তপন চৌধুরী, রোকিয়া আফজাল রহমান ও গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী। অনুষ্ঠানে ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট, শ্রীলঙ্কার হাইকমিশনার ইয়াসোজা গুনাসেকেরা, সিঙ্গাপুরের কনসাল ডেরিল লাউসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা। আরও ছিলেন শিল্পসচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ও এনএসআইয়ের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়াউল আহসান।
আরও উপস্থিত ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান, এসিআইয়ের চেয়ারম্যান আনিস-উদ-দৌলা, ব্যবসায়ী নেতা লায়লা রহমান কবীর, আইসিএবির সাবেক সভাপতি পারভীন মাহমুদ, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের, স্কয়ার গ্রুপের অঞ্জন চৌধুরী, কাজী ফার্মসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহিদ হাসান, সেন্ট্রাল উইমেনস্ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক মহাসচিব আইরিন খান, সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি হোসেন খালেদ, হা-মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল আলম পারভেজ, অ্যামচেমের সাবেক সভাপতি আফতাবুল ইসলাম, সিটিব্যাংক এনএর কান্ট্রি হেড রাশেদ মাকসুদ খান, ইস্টার্ণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার, ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান কামরান বকর, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ এ (রুমী) আলী, কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তৌফিক আলী প্রমুখ।
অনুষ্ঠানটি শুরু হয় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত এবং গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক পাঠের মধ্য দিয়ে। প্রতিটি ধর্মেই মানবতার স্থান যে সবকিছুর ওপরে, এটাই ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করা হয়।
উল্লেখ্য, গত ১ জুলাই ঢাকার হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়ানক হামলার ঘটনায় নিহত হন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফারাজ আইয়াজ হোসেন।