তুর্কি প্রেসিডেন্টের সেই অবিস্মরণীয় ফোন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: তুরস্কের সেনাবাহিনীর একাংশ গত ১৫ জুলাই রাতে আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুলে রাস্তায় নামে অভ্যুত্থান চালাতে। বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেওয়ায় পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। ওই রাতে দাবার আসল ঘুঁটির চাল দেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। অবকাশ যাপনে থাকা এরদোয়ান মোবাইল থেকে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে বার্তা পাঠান। ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) সমর্থকেরা তাঁর আহ্বানে রাস্তায় নেমে আসেন। ওই দিন রাতে সিএনএন-টার্কের নারী সংবাদদাতা হ্যান্ডে ফিরাতের মাধ্যমে বার্তা পাঠান এরদোয়ান। সেই রাতের কথাই তিনি জানিয়েছেন বার্তা সংস্থা এএফপিকে।
সাংবাদিক ফিরাত সিএনএন টার্কের আঙ্কারার ব্যুরোপ্রধান। গত ১৫ জুলাই অভ্যুত্থান রাতের ওই ফোন কলের কারণে দেশটিতে এখন জাতীয় আইকন তিনি। ওই রাতের তুর্কি প্রেসিডেন্টের ফোন পাওয়ার পর থেকেই ফিরাতের মোবাইল সেটটিও অন্যদের কাছে বেশ সাড়া ফেলেছে। সেই রাতের বর্ণনা দিয়ে ফিরাত বলেন, ‘টেলিভিশনে লাইভ অনুষ্ঠান প্রচারের সময় মোবাইল পর্দায় দেখতে পাই প্রেসিডেন্ট জীবিত। এরপরই আমি প্রেসিডেন্টের বার্তা সবার কাছে পৌঁছে দিলাম।’ ফোন পেয়ে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে আমি বললাম, ‘হ্যালো? দয়া করে বলুন মি. প্রেসিডেন্ট, আমরা আপনার কথা শুনছি…।’ ‘শুভ সন্ধ্যা!’ ‘শুভ সন্ধ্যা, স্যার, দয়া করে বলুন…।’

এরদোয়ান তাঁর মোবাইলের অ্যাপল অ্যাপ ফেসটাইমের মাধ্যমে সিএনএন-টার্কের নারী সংবাদদাতা হ্যান্ডে ফিরাতের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। হ্যান্ডে ফিরাত তাঁর অফিসের মোবাইলে দেখতে পান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের মুখ। মোবাইলে তিনি অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়ে তাঁর সমর্থকদের রাস্তায় নামার আহ্বান জানান। এরদোয়ানের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে অভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসেন তাঁর সমর্থকেরা। সংকটময় সন্ধিক্ষণে এই আহ্বান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল।

ফিরাত ইস্তাম্বুলে এক সাক্ষাৎকারে এএফপিকে বলেন, ‘আমি আমার ফোন বিক্রি করতে পারিনি। এটা আমি আমার ড্রয়ারে রেখে দিয়েছি এবং এটা মাঝে মাঝে বেজে ওঠে। হাত থেকে পড়ে ভেঙে যাওয়ার ভয়ে আমি ফোনটি ব্যবহার করি না।’ তুরস্কে অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দিতে সাহায্য করা এই ফোন ফিরাতের কাছ থেকে সৌদি আরব, কাতার এবং তুরস্কের ব্যবসায়ীরা কিনতে চেয়েছেন। কিন্তু তিনি বিক্রি করেননি।

ধ্যান ছিল কাজের ওপর
গত ১৫ জুলাই রাতে তুরস্কের রাষ্ট্র পরিচালিত প্রচারমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ নেয় বিদ্রোহী সেনারা। সেনারা টেলিভিশনে সারা দেশে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে দাবি করে একটি বিবৃতি পড়ে শোনাতে বাধ্য করে। রাতের ওই অভ্যুত্থানের পরে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের ব্যাপারে কিছু জানা যাচ্ছিল না। কারণ তিনি পরিবারের সঙ্গে সাগরপাড়ে অবকাশ যাপনে ছিলেন।

সিএনএনের তুর্কি ভাষার টেলিভিশন স্টেশন সিএনএন টার্ক দোগান মিডিয়া গ্রুপের মালিকানাধীন জনপ্রিয় একটি চ্যানেল। এই চ্যানেলের সঙ্গে এরদোয়ানের সম্পর্ক মাঝে মাঝে অস্বস্তিকর অবস্থায় পৌঁছে যায়। কিন্তু এরপরও ফোন করার জন্য তিনি বেছে নেন সেই সিএনএন টার্ককেই। ফিরাত বলেন, ‘ওই কল যখন আসে, তখন অতীতের সম্পর্কের কথা চিন্তা না করে শুধু সাক্ষাৎকারের ওপর ধ্যান দিয়েছিলাম।’ তিনি বলেন, ‘আমি যখন লাইভে ছিলাম, তখন খুব ভিতসন্ত্রস্ত এবং চিন্তিত ছিলাম। সেই মুহূর্তে আমার ধ্যান ছিল কাজ। কোনো কিছু ভাবার আগেই মোবাইল পর্দায় দেখতে পাই প্রেসিডেন্ট জীবিত। আমি কাজের ওপর নজর দিলাম। আল্লাহর ইচ্ছায় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি।’

ওই সাক্ষাৎকার প্রচারের পর রীতিমতো হইচই ফেলে দেওয়া ফিরাত বলেন, ‘আমার হাত কাঁপছিল, ক্যামেরায় তাঁকে (এরদোয়ানের) পুরোপুরি দেখা যাচ্ছিল, এ সময় কোনো প্রশ্ন করা উচিত কি না, তা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম।’
ওই রাতে তুরস্কের বিশৃঙ্খলা, রাজধানীতে বোমা-গুলি, আকাশে জেট বিমানের আনাগোনা, সেনা সংঘর্ষ নানান কিছু নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন ফিরাত। তিনি খোদার উদ্দেশে বলেন, ‘আমার দেশ অন্য এক দেশ হয়ে উঠছে? দেশে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে? পরদিনের সকালটি আমরা কীভাবে শুরু করব?’

স্বাধীনতার ফোন
এরদোয়ানের বেপরোয়া ওই ফোন কল ও সাক্ষাৎকার সিএনএন টার্ক প্রচার করার পরই নাটকীয়ভাবে তাঁর ভাগ্য বদলে যায়। অনিশ্চয়তা শেষে তিনি ইস্তাম্বুল পৌঁছান এবং পরদিন সকালে অভ্যুত্থান ভেস্তে যায়। ওই সাক্ষাৎকার প্রচারের পরই বিদ্রোহী সেনারা সিএনএন টার্কের কার্যালয়ে হানা দেয়। এরপরই সিএনএন টার্কের টিভি পর্দা কালো হয়ে যায় এবং মাঝে মাঝে গোলাগুলি ও কামানের শব্দ শোনা যায়।
তবে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পরই ওই চ্যানেল আবার প্রচারে ফিরে আসে। এরপরই এরদোয়ানের সঙ্গে ফিরাতের সেই সাক্ষাৎকার বারবার দেখানো শুরু হয়। ওই সাক্ষাৎকার দুই দিন ধরে প্রচারিত হয়।
এরদোয়ান দেশের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার পরই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। বিদ্রোহী সেনা ও এর সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেন। গ্রেপ্তার করা হয় ৩৭ হাজার জনকে।

ফিরাত বলেন, ‘ওই কলের প্রভাব তুরস্ক ও অন্যত্র রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ে। আমি পরদিন এর প্রভাব উপলব্ধি করি।’ তিনি বলেন, ‘আমি আরব বিশ্ব থেকে অনেক বার্তা পেয়েছি। তারা আমার টুইটার অ্যাকাউন্টে বলছে “ধন্যবাদ”, “এটাই একটি ফোনের স্বাধীনতা” এবং “তুমি এ অঞ্চলের ভাগ্য পরিবর্তন করেছ”।’

অত্যধিক প্রচার তাঁর কাজের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়েছিল কি না—এর উত্তরে ফিরাত বলেন, ‘মাঝেমধ্যে আমি এটা চিন্তা করি…কিন্তু আমি জানি যে এটা আমার কাজ এবং ওই রাতে আমি সত্যটা তুলে ধরতে চেয়েছি।’

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ