এ কেমন বিচার!

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: আফরোজা খাতুনের বয়স হয়েছিল মাত্র ১৬ বছর। কিন্তু এই বয়সে পৃথিবীর কদর্য রূপটি দেখা হয়ে যায় তার। মরে যায় বেঁচে থাকার সব ইচ্ছা। নির্দয় এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়—এমনটা নিশ্চয়ই মনে হয়েছিল তার। তাই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় সে।

আফরোজার বাড়ি ছিল সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার সোনাবাড়িয়া গ্রামে। ১২ ডিসেম্বর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে আফরোজার আত্মহত্যার খবরটি প্রকাশিত হয়।

প্রকাশিত খবরের তথ্য অনুযায়ী, ৯ ডিসেম্বর এলাকার এক যুবকের সঙ্গে আফরোজার অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগ তোলে স্থানীয় লোকজন। বিষয়টি সোনাবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলামকে জানানো হয়। এরপর চেয়ারম্যানের নির্দেশে দুজনকে দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে ইউপি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় অনেকে এ দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করে ফেসবুকে ছেড়ে দেন। সেখানে চেয়ারম্যান ও অন্যরা যুবককে লাঠি দিয়ে পেটান। আর আফরোজাকে চেয়ারম্যান গালিগালাজ করেন এবং চড়-থাপ্পড় মারেন। এরপর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ক্ষোভে ও লজ্জায় পরদিন শনিবার আফরোজা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে।

আহারে! কী অসহায়ই না বোধ করছিল আফরোজা, যখন তাকে আর দশটা লোকের সামনে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা হচ্ছিল আর চড়-থাপ্পড় মারা হচ্ছিল। প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ হচ্ছিল না। অপমানে কুঁকড়ে গিয়েছিল সে। এ কেমন বিচার? এ কেমন সমাজে আমরা বাস করছি। যারা এ কাজটি করেছে, তাদের কে এই অধিকার দিয়েছে?
সোনাবাড়িয়া ইউপির চেয়ারম্যানই যে প্রথম এমন কাণ্ড ঘটালেন তা নয়, গত মার্চ মাসে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার গজালিয়ার ইউপির চেয়ারম্যান খালিদুল ইসলাম দেবর-পুত্রের সঙ্গে পরকীয়ার অভিযোগে এক গৃহবধূকে গ্রাম্য সালিসে লাঠি দিয়ে পেটান। এতেও তিনি ক্ষান্ত হননি। ওই গৃহবধূর মাথা ন্যাড়া করে দেন। আর দেবর-পুত্রকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেন।
গত নভেম্বর মাসে যশোরের কেশবপুরে প্রেম করার অপরাধে দুই তরুণ-তরুণীকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নির্যাতন করেন উপজেলার বিদ্যানন্দকাটি ইউপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হাসিয়ার রহমান।
২০১৪ সালের এপ্রিল মাসের ঘটনা। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার আবদুল্লাহপুর ইউপির চেয়ারম্যান ইসমাইল হোসেন রাসেলের কাছে স্বামীর নির্যাতনের বিচার চাইতে এসেছিলেন এক গৃহবধূ। বিচার করা তো দূরের কথা। উল্টো গৃহবধূকে ধর্ষণ করলেন চেয়ারম্যান। ২০১১ সালে রংপুরের বদরগঞ্জে পরকীয়ার অভিযোগে এক গ্রাম্য সালিসে মধুপুরের ইউপির চেয়ারম্যান আইনাল হক ও তাঁর লোকজন দুই নারীকে বিবস্ত্র করে লাঠিপেটা করেন।
ইউপির চেয়ারম্যানের অন্য অনেক দায়িত্বের মধ্যে একটি হচ্ছে বিচার-বিষয়ক কার্যাবলি। এর মধ্যে রয়েছে গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান হিসেবে বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমার নিষ্পত্তি করা।

এ ছাড়া ছোটখাটো ঝগড়া-বিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, জমিজমাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় ব্যক্তিগত উদ্যোগে সালিসের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিচারের নামে কোনো কোনো চেয়ারম্যান মারধর করছেন, মাথা ন্যাড়া করছেন বা ধর্ষণ করছেন। এমনও দেখা গেছে, তাঁরা প্রভাবশালীদের পক্ষ নিয়ে দুর্বলদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছেন। কিন্তু এসব অন্যায় করার পরও তাঁদের কোনো শাস্তি হচ্ছে না।
বদরগঞ্জে দুই নারীকে বিবস্ত্র করে লাঠিপেটার ঘটনায় সেই সময় হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গ্রাম্য সালিসের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। বাস্তবতা হলো, এখনো গ্রাম্য সালিস বসছে। আর সেই সব সালিসে লোকজনকে অপমান, হেনস্তা ও নির্যাতন করা হচ্ছে। ওই ঘটনায় চেয়ারম্যান আইনাল হকের বিরুদ্ধে মামলা হলেও এখনো এর বিচার কার্যক্রম শুরু হয়নি। আইনাল হক চেয়ারম্যান পদে বহাল তবিয়তে আছেন।
গলাচিপার গজালিয়ার ইউপির চেয়ারম্যান খালিদুল ইসলাম যখন দেবর-পুত্রের সঙ্গে পরকীয়ার অভিযোগে এক গৃহবধূর মাথা ন্যাড়া করে দেন, তখন তিনি সদ্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

ওই ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হলে তিনি গা ঢাকা দেন। এই গা ঢাকা দেওয়া অবস্থায়ই এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে শপথ নেন। পুলিশ এ মামলায় খালিদুলকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দিয়েছিল পটুয়াখালীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আদালতে। পরে আদালত বাদীকে প্রভাবিত করে সমঝোতার ভিত্তিতে মামলা নিষ্পত্তি করেন। এ মনে হয় আমাদের দেশেই সম্ভব।
আফরোজা আত্মহত্যা করার পর নারী নির্যাতন ও আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলায় সোনাবাড়িয়া ইউপির চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলামকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু মনিরুলের শাস্তি হবে—সেই ভরসা কি আমরা করতে পারি?
আইন তো সবার জন্যই সমান হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আইন আমাদের দেশে প্রভাবশালীদের পক্ষে। এখতিয়ার না থাকা সত্ত্বেও তা×রা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন। এই পরিস্থিতির অবসান হবে কবে? আদৌ হবে কি?

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ