বাংলাদেশ সীমান্তে নতুন আরাকানি জঙ্গিগোষ্ঠী !
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: ব্রাসেলসভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ আইসিজির সদ্য প্রকাশিত ৩৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি আমাদের জন্য গভীর শঙ্কা বয়ে এনেছে। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, সামনের দিনগুলোতে যেন হারাকা আল-ইয়াকিন ধরনের কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর নাম আমাদের গণমাধ্যমের শিরোনামে পরিণত না হয়। এই নামে আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে এই প্রথমবারের মতো পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সঙ্গে যোগাযোগ থাকা একটি ইসলামি গোষ্ঠীর সক্রিয় থাকার কথা প্রকাশ পেয়েছে। গত ৯ অক্টোবর ও পরে নভেম্বরে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর ওপর ওই গোষ্ঠী জঙ্গি হামলা চালায় বলেই আইসিজির দাবি। যদি ভৌগোলিকভাবে দেখি তাহলে ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি হামলার পরে কাছাকাছি কোনো দূরত্বে এটাই কোনো ইসলামি গোষ্ঠীর বড় হামলা। দুইয়ের মধ্যে একটা মিল হলো, হলি আর্টিজানের পরে আমরা যখন আইএস থেকে বেঁচে কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছিলাম, তখন রোহিঙ্গা স্রোত আমাদের বিচলিত করল। ভারতের সঙ্গে মিলে আমরা নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নতি করেছিলাম। এবারের অন্যতম সমস্যা হলো ভারতের মতো মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সম্পর্ক ও বোঝাপড়া শক্তিশালী নয়। আইসিজির রিপোর্ট স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে যে আল-ইয়াকিনের সঙ্গে আইএস বা আল-কায়েদার একটা যোগসূত্র ঘটে যেতে পারে।
আপাতত এই রিপোর্ট মিয়ানমার সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলে কিছুটা সহায়ক হতে পারে বলে প্রতীয়মান হয়। অং সান সু চি এর আগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দোষারোপ করেছিলেন। সু চির যুক্তি ছিল অনেকটা এ রকম, ৯ অক্টোবর ৯ পুলিশ নিহত হয়েছে। ১২ নভেম্বর এক জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। সুতরাং এরপর সেখানে যা ঘটেছে সেটা হলো সু চির কথায় ‘আইনের শাসন’। ‘আইনের শাসন’ প্রতিষ্ঠার কারণে ২৭ হাজার রোহিঙ্গা কেবল বাংলাদেশেই পালিয়ে এসেছে। কতজন নিহত হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। সবকিছুর মূলে ৯ অক্টোবরের তথাকথিত ‘আল-ইয়াকিন’ পরিচালিত হামলা। নোবেলজয়ী সু চির দেশের নেতারা হয়তো হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। কারণ, নয়া বিশ্বনেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর মিত্ররা হয়তো আগের চেয়ে একটু ভালোভাবেই উপলব্ধি করবেন যে হেলিকপ্টার থেকে হামলা, মানুষ হত্যা ও গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করার ঘটনা হলো সু চি বর্ণিত ‘আইনের শাসনের’ নমুনা।
আইসিজি একটি মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান। বিশ্ব সুশীল সমাজের একটি নির্ভরযোগ্য সংস্থা হিসেবে তার একটি পরিচিতি আছে। গণহত্যা শব্দটি তারা কীভাবে ব্যবহার করেছে, সেটা খুব খেয়াল করে লক্ষ করলাম। ৭ নোবেলজয়ী আরেক নোবেলজয়ীর দেশে ‘পদ্ধতিগত গণহত্যার’ কথা উল্লেখ করেছিলেন গত বছর। অথচ আইসিজি তার রিপোর্টে একটিবার ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। সেটাও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বরাতে। আর ইয়াঙ্গুন ও ব্রাসেলস থেকে একই সঙ্গে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি যে ঘটনা নিয়ে এতটা তুলকালাম, সেই ৯ অক্টোবরের ঘটনার পুরো বিবরণ শুধু সরকারি ভাষ্যের বরাতে ব্যবহার করেছে। এমনকি ওই ভাষ্যের সত্যতা নিরূপণের বা তৃতীয় কোনো সূত্রে যাচাই করার উদ্যোগ তারা নিয়েছে বলে রিপোর্টে অন্তত উল্লেখ পাই না।
আইসিজি খুবই সতর্কতা ও বিনয়ের সঙ্গে বলেছে, সামরিক বাহিনী যে শক্তি (ব্রিটিশ ইনডিপেনডেন্ট যদিও বলেছে, হেলিকপ্টার থেকে নির্বিচারে গুলি করে গণহত্যা হয়েছে) প্রয়োগ করেছে তা ‘ডিসপ্রপোরশনেট’ (মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ অর্থে)। আইসিজির মতে, সামরিক বাহিনী জঙ্গি ও নিরীহ মানুষের ফারাক করতে পারেনি!
এর আগের লেখায় আমরা যে সংশয় প্রকাশ করেছিলাম, আইসিজি সেটা নিশ্চিত করেছে। তারা বলেছে, অং সান সু চির কিছুটা প্রভাব থাকলেও সামরিক বাহিনীর ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, আমাদের ঘরের কাছে একটি সামরিক বাহিনী থেকে যাবে, যার ওপর আগের মতোই কোনো কার্যকর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। একটি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা জঙ্গিবাদ তারাই মোকাবিলা করবে, যার ওপর পেশাদার রাজনীতিবিদদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। আইসিজি বলেছে, ২০১৫ সালের আগে ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির শেষ সম্পর্কটা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমার (জিএনএলএম) মিয়ানমার সরকারের মুখপত্র। আইসিজির ৩৪ পৃষ্ঠার রিপোর্টে জিএনএলএম শব্দটির ২৬ বার উল্লেখ আছে। এই পত্রিকার মতে, ৯ অক্টোবরের পরে ৮৬ রোহিঙ্গা মরেছে। আইসিজির ওয়েবসাইট প্রধান শিরোনাম করেছে, রাখাইনে নতুন মুসলিম ইনসারজেন্সি। আইসিজি তার ওয়েবসাইটে যে এক্সিকিউটিভ সামারি বড় হরফে প্রদর্শন করেছে, সেখানে তারা কিন্তু মিয়ানমারের সরকারি বিবরণী নিজেদের বক্তব্য হিসেবে প্রচার করেছে। আমরা অবশ্যই মানব যে বাস্তবে এই ভাষ্যই যথার্থ হতে পারে। কিন্তু যেহেতু আমরা জানি যে কোনো স্বাধীন আন্তর্জাতিক সংস্থা বা বিদেশি নাগরিকদের রাখাইনে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না, তাই আইসিজি কীভাবে তথ্য পেল তা জানানোটা দরকার ছিল।
আইসিজি কি আমাদের বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখ খুলে দিল? আমরা তো এই ধারণা করছিলাম যে ‘বাঙালি’ বলে মিয়ানমার যাদের তাড়াতে চেয়েছিল, তাদের ওপর তাদের ধারাবাহিক হামলার একটা পর্যায়ে ৯ অক্টোবরের ঘটনা ঘটে থাকবে। আরাকান রূপান্তরিত রাখাইন থেকে রোহিঙ্গারা বিশ্বের দেশে দেশে পালিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। আইসিজি বলছে, সাম্প্রতিক যে সহিংসতা ঘটে গেল, সেটা গত কয়েক দশক থেকে ‘কোয়ালিটিভলি ডিফারেন্ট’ (গুণগতভাবে আলাদা)। তার মানে কী দাঁড়ায়? এটা আলাদা হলো মুসলিম জঙ্গিগোষ্ঠীর জড়িত হওয়ার কারণেই? নাকি সামরিক বাহিনীর কোনো অংশের জাতিগত নির্মূল অভিযান বেপরোয়া হওয়ার কারণেই? নিশ্চয় উভয়ের মিশ্রণ হতে পারে।
এটুকু বুঝলাম, বাংলাদেশের উচিত হবে রোহিঙ্গা বিষয়টিকে আর কেবলই মানবিক কিংবা ১৯৭৮ বা ১৯৯১-৯২ সালের পর্বের মতো করে না দেখা। জাতীয় প্রতিরক্ষার দিক থেকে খুব গভীরভাবে খতিয়ে দেখা। ওই জঙ্গি গ্রুপ নাকি ‘ওয়েল ফান্ডেড’। এবং তারা ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। বিশ্বরাজনীতিতে ‘গেম চেঞ্জার’ কথাটি খুব নিরীহ নয়। তা নিয়ে আমাদের খুব সতর্ক হওয়ার দরকার আছে।
আল-ইয়াকিন সম্পর্কে যে তথ্য মিয়ানমারের বিশ্বকে নির্দিষ্টভাবে জানানোর কথা, সেটা আইসিজি জানাল। দারফুরের সংঘাত সম্পর্কে তারাই প্রথম বিপদ-ঘণ্টা বাজিয়েছিল। সে কারণে কলিন পাওয়েল তাদের প্রশংসা করেছিল। আইসিজির বিবরণ এ রকম: ‘গত ৯ অক্টোবর রোহিঙ্গাদের একটি গ্রুপ কথিতমতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে হামলা চালিয়ে ৯ পুলিশকে হত্যা করেছিল। এখন জানা গেছে হামলাকারীরা সৌদি আরব ও পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত। হারাকা আল-ইয়াকিন নামের একটি গোষ্ঠী এক ভিডিও বার্তায় বর্মি পুলিশের ওপর হামলার দায় স্বীকার করেছে।’ আমরা মনে রাখব যে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক পাল্টা হামলা চালাতে বিক্ষুব্ধ মানুষের কোনো ঘাটতি থাকার কথা নয়। সুতরাং প্রতিকারটি হলো মুসলিম জঙ্গি ও রাষ্ট্রের জঙ্গিত্ব একসঙ্গে বন্ধ করা। এই দিকটিকে এখন থেকেই কি বড় করে দেখা হবে? নাকি ‘গেম চেঞ্জাররা’ তা হতে দেবে না!
আইসিজি প্রতিবেদন বলেছে, ‘২০১২ সালের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ১০০-এর বেশি নিহত এবং প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হওয়ার পরে হারাকা আল-ইয়াকিন গঠিত হয়। অনলাইনে প্রচারিত নয়টি ভিডিওতে এই গ্রুপটির নেতা হিসেবে যাকে দেখা যায়, তার নাম আতা উল্লাহ। পাকিস্তানের করাচিতে জন্মের পরে শৈশবেই তিনি সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন এক অভিবাসী রোহিঙ্গা। আইসিজি নিশ্চিত হতে না পারলেও ইঙ্গিত দিয়েছে যে আতা উল্লাহ পাকিস্তানসহ “অন্যত্র” সফর করেছিলেন। আর সেখানে তিনি আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। তিনি রাখাইনের হামলায় সৌদি আরব থেকে অংশ নেওয়া ২০ জন রোহিঙ্গার একটি গোষ্ঠীর অন্যতম কুশীলব। এ ছাড়া ২০ জন জ্যেষ্ঠ রোহিঙ্গার একটি পৃথক গ্রুপ ওই গোষ্ঠীর তদারক করে থাকে। তাদের সদর দপ্তর মক্কায় অবস্থিত।’ এ ছাড়া সৌদিতে বেড়ে ওঠা ও ফতোয়া জারির ক্ষমতাসম্পন্ন সেখানকার এক রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত মুফতির নাম জানা গেল। তিনি জিয়াবুর রহমান। টাইম সাময়িকীতে আইসিজির এই প্রতিবেদন বিষয়ে ১৩ ডিসেম্বরে একটি রিপোর্ট ছাপা হয়। সেখানে লক্ষণীয়ভাবে এই তথ্য উল্লিখিত হয়েছে, ‘বাংলাদেশ থেকে কয়েক শ রোহিঙ্গা ইয়াকিনে যোগ দিতে আরাকান গেছে।’ আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে এর আগে ছোটখাটো সশস্ত্র গ্রুপ কাজ করেছে। কিন্তু তারা সেভাবে র্যা ডিকালাইজড ছিল না। তার মানে আমরা এখন নিরীহ রোহিঙ্গাই পাচ্ছি না। পাচ্ছি তেমন রোহিঙ্গাও, যারা ইতিমধ্যে র্যা ডিকালাইজ হতে পারে। আর আমাদের সমাজের র্যা ডিকালিস্টদের সঙ্গে তাদের নৈকট্য স্বাভাবিক। ফলে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে কোনো আশা–ভরসা দেখাতে না পারলে পরিস্থিতি ভয়ংকর রূপ নিতে পারে বলে আইসিজির আশঙ্কার সঙ্গে একমত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
মূল সমাধান অং সান সু চির নেতৃত্বে মিয়ানমারের রাজনৈতিক উত্তরণ। দেশটির সামরিক বাহিনীর ওপর পূর্ণ ও কার্যকর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। আর বাংলাদেশের উচিত বিশেষ করে চীন ও ভারতকে অনুরোধ করা, যাতে তারা এই ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়।