রাষ্ট্রপতি আশাবাদী

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পদ্ধতিগত বিষয় ও অনুসন্ধান কমিটি (সার্চ কমিটি) নিয়ে রাষ্ট্রপতিকে সুনির্দিষ্ট মতামত দিয়েছে বিএনপি। বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা আলোচনার পর দলটির মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেছেন, এই সংলাপে বিএনপি খুশি হয়েছে, আশাবাদী হয়েছে।

পরে বঙ্গভবন থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, অনুসন্ধান কমিটি গঠন ও নির্বাচন কমিশন গঠন-প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিএনপি যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা নির্বাচন কমিশন গঠনে সহায়ক হবে।

তবে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিএনপির এই সংলাপের সফলতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান যখন তাঁদের ডেকেছিলেন, তখন তাঁরা গিয়েছিলেন, তখন তাঁদের মনমতো হয়নি। সালিস মানি তালগাছটা আমার, এই যদি বিএনপির নীতি হয়, তাহলে আজকের সংলাপ সফল হবে না।’ গতকাল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এক আলোচনা সভায় ওবায়দুল কাদের এ বক্তব্য দেওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির উদ্যোগকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপি যদি গণভবনে যেত, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস ভিন্ন হতে পারত।

বিএনপির সূত্র জানায়, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদলের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল সবার কাছে আস্থাশীল একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন। এ লক্ষ্যে গত নভেম্বরে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যে ১৩ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন, তার সারাংশ রাষ্ট্রপতির কাছে তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি প্রস্তাবের একটি পূর্ণ কপিও রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়।

পরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ

 বলেন, অত্যন্ত ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। রাষ্ট্রপতিও মনে করেন, সংকট নিরসনে আলোচনা দরকার। বিএনপিও আশা করছে, এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি যথাযথ ভূমিকা পালন করবেন।

দলের দায়িত্বশীল একটি সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির পক্ষ থেকে তাদের প্রস্তাবের আলোকে অনুসন্ধান কমিটির জন্য ১০ জনের একটি তালিকা রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়েছে।কিন্তু দলটি চায় না কোনোভাবে নামগুলো এখনই প্রকাশ হোক। কারণ, বিএনপি মনে করে, নাম প্রকাশ হলে তাঁদের নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হবে। গণমাধ্যম তাঁদের নিয়ে লেখালেখি করবে। এতে যাঁদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, তাঁরা বিব্রত হতে পারেন। এ জন্য প্রস্তাবিত নামগুলোর বিষয়ে বিএনপি গোপনীয়তা অবলম্বন করছে।

এ বিষয়ে সংবাদ ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকেরা জানতে চান। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরাসরি কোনো উত্তর দেননি। তিনি বলেন, এ বিষয়ে খালেদা জিয়া সুনির্দিষ্ট মতামত দিয়েছেন।

বিএনপির প্রস্তাব অনুযায়ী, বাছাই কমিটি হবে পাঁচ সদস্যের। এর আহ্বায়ক হবেন অবসরপ্রাপ্ত এবং কর্মক্ষম একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি (জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে)। অন্য সদস্যরা হবেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি, সরকারের অবসরপ্রাপ্ত একজন সচিব (তবে অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন কোনো কর্মকর্তা বাছাই কমিটির সদস্য হতে পারবেন না), বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত একজন অধ্যাপক বা দলনিরপেক্ষ সর্বজনশ্রদ্ধেয় একজন বিশিষ্ট নাগরিক এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয় দলনিরপেক্ষÿএকজন জ্যেষ্ঠ নারী।

রাষ্ট্রপতিকে চিঠি: বঙ্গভবনে আলোচনার শেষ পর্যায়ে রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত চিঠি দেন খালেদা জিয়া। পরে ওই চিঠি এবং নির্বাচন কমিশন গঠনে দলীয় প্রস্তাবের কপি গণমাধ্যমে পাঠায় বিএনপি। চিঠিতে খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতিকে বলেন, ‘আমরা মনে করি আমাদের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। … জাতির অভিভাবক হিসেবে এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে আপনি যে উদ্যোগ নিয়েছেন, সে উদ্যোগ সফল হবে।’

আর নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো দলীয় প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করে তাতে সাড়া দিয়ে সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে আলোচনার জন্য ডাকায় রাষ্ট্রপতিকে অভিনন্দন জানান খালেদা জিয়া । তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশে বিশেষ করে গত দুটি জাতীয় নির্বাচনে এবং গত কয়েক বছরে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা দেশে-বিদেশে আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা সম্পর্কে জনগণকে হতাশ, আস্থাহীন ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। বৃহত্তর জাতীয় ও গণতন্ত্রের স্বার্থে এ পরিস্থিতি আর চলতে পারে না।’

মির্জা ফখরুলের ব্রিফিং: বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা শেষে গতকাল রোববার সন্ধ্যায় নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ব্রিফিং করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির সংলাপের উদ্যোগ সংকট উত্তরণে ফলপ্রসূ হবে এবং রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতি যথাযথ ভূমিকা রাখবেন বলে আশা করছে বিএনপি।

মির্জা ফখরুল বলেন, অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি আপাদমস্তক রাজনৈতিক নেতা। বিএনপি খুশি হয়েছে, আশাবাদী হয়েছে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি বলেছেন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। তিনি প্রস্তাব দেওয়ার জন্য খালেদা জিয়াকে ধন্যবাদ জানান। রাষ্ট্রপতি বলেছেন, পদ্ধতিগত বিষয়গুলো তিনি পরীক্ষা করবেন। তিনিও মনে করেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।

বিএনপির মহাসচিব বলেন, তাঁরা আশা করছেন, এক মাসের মধ্যে পদ্ধতিগত বিষয়গুলো নিয়ে রাষ্ট্রপতি কাজ শেষ করবেন এবং আবার আলোচনার উদ্যোগ নেবেন। যেহেতু নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন নেই, তাই সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করা জরুরি।

রাষ্ট্রপতির প্রেস উইংয়ের বক্তব্য

সন্ধ্যায় বঙ্গভবনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিএনপির ১১ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলের নির্বাচন কমিশন গঠন-সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়। রাষ্ট্রপতি বলেছেন, আজকের আলোচনা গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো আলোচনা সমস্যা সমাধানে বহুমুখী পথ দেখায়। অনুসন্ধান কমিটি গঠন ও নির্বাচন কমিশন গঠন-প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিএনপি যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা নির্বাচন কমিশন গঠনে সহায়ক হবে। তিনি এ ব্যাপারে বিভিন্ন দলের সহায়তা কামনা করেন।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, নির্বাচন কমিশন গঠনে খালেদা জিয়া প্রস্তাব তুলে ধরেন। এ ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন ও নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণেও তাঁদের প্রস্তাব তুলে ধরেন।

সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস জানায়, বঙ্গভবনের দরবার হলে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন আলোচনার বিভিন্ন বিষয় সাংবাদিকদের জানান। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনায় প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে।

রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি বিএনপির প্রতিনিধিদলকে বলেন যে আজকের আলোচনা এবং আপনাদের সুচিন্তিত মতামত শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’

বঙ্গভবনে যাত্রা: রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকের নির্ধারিত সময় বিকেল সাড়ে চারটার কিছু আগেই খালেদা জিয়া বঙ্গভবনে পৌঁছান।এ জন্যতাঁর গাড়ি বঙ্গভবনের কাছে রাজউকের সামনে কিছু সময় দাঁড়িয়ে ছিল। তখন বঙ্গভবনের সামনে অন্যান্য গাড়িতে অপেক্ষা করছিলেন অন্য নেতারা। বঙ্গভবনে তাঁদের স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের অতিরিক্ত সচিব ওয়াহিদুল ইসলাম খান। প্রতিনিধিদলে ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, জমির উদ্দিন সরকার, মাহবুবুর রহমান, রফিকুল ইসলাম মিয়া, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থাহীন বিএনপি সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন করতে রাষ্ট্রপতির প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে। নতুন যে কমিশন গঠন করা হবে, তার অধীনেই ২০১৯ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা।

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে আলোচনার জন্য রাষ্ট্রপতি বিএনপিসহ পাঁচটি দলকে ডেকেছেন। ২০ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টি (জাপা), ২১ ডিসেম্বর এলডিপি ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও ২২ ডিসেম্বর জাসদের (ইনু) সঙ্গে আলোচনা হবে।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির কী আলোচনা হয়েছে, আমরা জানি না। তবে রাষ্ট্রপতির ডাকার বিষয়টি ইতিবাচক। আর বিএনপির আলোচনায় অংশ নেওয়াও ইতিবাচক। আওয়ামী লীগকে ডাকলে আমরাও আমাদের মতামত তুলে ধরব। আশা করি, রাষ্ট্রপতি এর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও দ্য ঢাকা ফোরামের সভাপতি সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনার পর দুই পক্ষের যে কথাবার্তা, তা খুবই ভালো লক্ষণ। সবার সঙ্গে আলোচনা করে যদি একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনে ঐকমত্যে আসা যায়, তা সবার জন্যই ভালো হবে।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ