নারায়ণগঞ্জে কী হবে আগামীকাল ?
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: নারায়ণগঞ্জে কী হবে আগামীকাল? ভোটাররা কি নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন? নির্বাচনে কি গণরায়ের প্রতিফলন ঘটবে? ইত্যাকার নানা প্রশ্ন উঠেছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘিরে।
বাংলাদেশে যেকোনো নির্বাচনই উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, যদি না ক্ষমতাধরেরা সেই উৎসব গায়ের জোরে বিষাদে পরিণত করেন। এবারের নারায়ণগঞ্জ বাড়তি মনোযোগ কেড়েছে এ কারণে যে, এটাই দলীয় প্রতীকে প্রথম সিটি করপোরেশন এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে শেষ নির্বাচন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেছেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। নির্বাচন দুভাবেই অনুকরণীয় হয়। নব্বই দশকে যে মাগুরা উপনির্বাচন নিয়ে শোরগোল হয়েছিল, সেটাই পরবর্তীকালে দেশময় ছড়িয়ে পড়েছে পূর্বাপর সরকারের আমলে। আশা করি, রকিব সাহেব তাঁদের সর্বশেষ নির্বাচনে সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন না।
গত কয়েক সপ্তাহে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকা ঘুরে দেখেছি, নির্বাচন নিয়ে সেখানে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা রয়েছে। প্রার্থীরা যেখানেই গিয়েছেন, বিভিন্ন স্তরের মানুষ ভিড় জমিয়েছেন। এটি আশার কথা। কিন্তু শঙ্কাও আছে। ১৪ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলেছেন, ‘মেয়র পদে আমরা ভালো প্রার্থী পেলেও কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের অনেকের নামই কালিমালিপ্ত। তাঁদের কারও কারও বিরুদ্ধে হত্যা, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির মামলাও আছে। নির্বাচন কমিশন শেষ পর্যন্ত এসব প্রার্থীর ওপর নজরদারি জারি না রাখলে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণ অসম্ভব হয়ে পড়বে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে যে সাতজন প্রার্থী (পরবর্তী সময়ে দুজন এক প্রার্থীর সমর্থনে সরে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা দিয়েছেন) রয়েছেন, তাঁদের সবাই সজ্জন। বিশেষ করে বড় দুই দল—আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ও বিএনপির মনোনীত প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান ভালো মানুষ হিসেবেই পরিচিত। গোটা নির্বাচনী প্রচারে এই দুই প্রার্থী দলের ও নিজের পরিকল্পনার কথাই বলেছেন, ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষের কাছে ভোট চেয়েছেন। তাঁরা একে অপরের সমালোচনা করলেও শালীনতার মাত্রা ছাড়াননি। আমাদের জাতীয় নেতারা নারায়ণগঞ্জের প্রার্থীদের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারেন।
এও সত্য যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী দল বিএনপি সিটি নির্বাচনকে নিয়েছে চ্যালেঞ্জ হিসেবে। আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ হলো বিজয় ধরে রাখা। বিএনপির চ্যালেঞ্জ সরকারি দলকে অজনপ্রিয় প্রমাণ করা। তবে বিএনপির সমস্যা হলো, তাদের প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খান রাজনৈতিক অঙ্গনে কম পরিচিত, যদিও সাত হত্যা মামলায় তিনি সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর প্রতিপক্ষ সেলিনা হায়াৎ আইভী ২০১১ সালে চরম প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে কেবল মেয়রই হননি, পাঁচ বছর দক্ষতার সঙ্গে সিটি করপোরেশন পরিচালনাও করেছেন। বিএনপির নেতারা মনে করেন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী যত শক্তিশালীই হোন না কেন, এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ‘নৌকার’ বিপক্ষে ‘ধানের শীষের’ জোয়ার আসবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতাদের ধারণা, সেলিনা হায়াৎ আইভী গত পাঁচ বছর যে কাজ করেছেন, তাতে ধানের শীষের পক্ষে জোয়ার আসার প্রশ্নই আসে না।
নির্বাচন নিয়ে কার হিসাব-নিকাশ মিলবে, কারটা ভেস্তে যাবে, সেটি জানা যাবে ২২ ডিসেম্বর। বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, তাঁরা নির্বাচনের দৃশ্যমান পরিবেশে অখুশি নন। ইতিমধ্যে সেখানে ২২ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে, পুলিশ, র্যা ব ও আনসার সদস্যদের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান বলেছেন, ‘নির্বাচনে কেউ ভোটকেন্দ্র দখল ও ব্যালট বাক্স ছিনতাই বা জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্ন করার চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি ছুড়বে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কোন বাহিনীর কতজন সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, নির্বাচন ঘিরে যাতে কেউ গুন্ডামি-মাস্তানি করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নারায়ণগঞ্জের দৃশ্যমান পরিস্থিতি ঠিকই আছে। সমস্যা হলো অদৃশ্যমান তৎপরতা। গণমাধ্যমে খবর এসেছে, সাংসদ শামীম ওসমান তাঁর সমর্থক সব কাউন্সিলর পদপ্রার্থীকে জয়ী করার জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কাছে আবদার জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কাউন্সিলর প্রার্থী নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই। তাঁরা দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচনও করছেন না। এরপরই নারায়ণগঞ্জের একটি পত্রিকা রিপোর্ট করেছে, ‘শামীম সমর্থক কাউন্সিলর প্রার্থীদের বধ করতে তৎপরতা চলছে।’ এখন অদৃশ্য শক্তি সেই ‘বধ’ শঙ্কা ঠেকাতে কাকে বধ করবে, সেই প্রশ্ন সবার মনে। আগামী ৪৮ ঘণ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভোট গ্রহণের আগ মুহূর্তে, ভোট গ্রহণের সময় এবং ভোট গ্রহণের পর পরিবেশ কেমন থাকে, অদৃশ্য শক্তি কোনো অঘটন ঘটায় কি না, সেটাই দেখার বিষয়। অপশক্তি দৃশ্যমান হোক বা অদৃশ্যমান, মোকাবিলার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আরও নির্দিষ্ট করে বললে সরকারের। কেননা, নির্বাচন কমিশন ওই কাজটি করতে পারবে না, যদি না প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে সহায়তা করে। আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন যত শক্তিশালীই হোক না কেন, সরকারের সহায়তা ছাড়া তারা কিছুই করতে পারবে না। তাই এই নির্বাচনটি যত না নির্বাচন কমিশনের চ্যালেঞ্জ, তার চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সরকারের জন্য। কাজী রকিব কমিশন আগামী ফেব্রুয়ারিতে বিদায় নেবে, এরপর নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে, ইতিমধ্যে যার আলোচনা শুরু করেছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। আলোচনাটি সঠিক খাতে প্রবাহিত করতেও নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনটি মুখ্য ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি। নির্বাচনটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হলে ভবিষ্যতে নির্বাচনের ব্যাপারে কিছুটা হলেও আশা থাকবে। আর প্রশ্নবিদ্ধ হলে রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংশয় ও সন্দেহ আরও বাড়বে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। নির্বাচন ভালো হলে শেষ পর্যন্ত সরকারই তার কৃতিত্ব নিতে পারবে। নির্বাচনটি খারাপ হলে তার সিংহভাগ বদনামও সরকারকে নিতে হবে।