রুশ-তুর্কি বন্ধুত্ব কি আবার ভেঙে যাবে ?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: সোমবার সন্ধ্যায় তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারার এক আর্ট গ্যালারিতে ‘তুর্কিদের চোখে রাশিয়া’ শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনী বক্তৃতা করার সময় ২২ বছর বয়সী এক তুর্কি যুবকের উপর্যুপরি গুলিতে তুরস্কে রুশ রাষ্ট্রদূত আন্দ্রেই কার্লোভের মৃত্যু এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়গুলোর অন্যতম। প্রায় সব সংবাদপ্রতিষ্ঠানের প্রথম সাধারণ প্রতিক্রিয়া হলো, এই হত্যাকাণ্ড সিরিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধে রুশ হস্তক্ষেপের ফল। এ রকম ধারণার প্রকাশ্য কারণ, হত্যাকারী যুবকটি রুশ রাষ্ট্রদূতকে পিস্তল থেকে পর পর সাতবার গুলি করার পর চিৎকার করে বলেছেন, ‘আলেপ্পোর কথা ভুলে যেয়ো না, সিরিয়ার কথা ভুলে যেয়ো না।’
কিন্তু নির্দিষ্টভাবে আলেপ্পো শহরে ও সামগ্রিকভাবে গোটা সিরিয়ায় ২০১১ সাল থেকে যে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, তাতে বাইরে থেকে হাত গলিয়ে দিয়েছে শুধু রাশিয়া নয়; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সৌদি আরব, বাহরাইন, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত—এই দেশগুলোর যৌথ বাহিনী বরং রাশিয়ার এক বছর আগে থেকেই সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ চালিয়ে আসছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে আলেপ্পো শহর ও তার চারপাশে আকাশ থেকে যে ব্যাপক বোমা হামলা চলেছে, তা শুধু রুশ বিমানবাহিনীর কর্ম নয়। মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনীও রুশ বিমানবাহিনীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওই অঞ্চলে ব্যাপক বোমা হামলা চালিয়েছে। তারা চাইছিল, আলেপ্পো থেকে আইএস যোদ্ধারা পালিয়ে যাওয়ার পর শহরটির নিয়ন্ত্রণ যেন প্রেসিডেন্ট বাশারের সরকারি বাহিনীর হাতে ফেরত না যায়। সেখানে যেন বাশার-বিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর জোট ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’র
নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু আমেরিকানদের এই খায়েশ পূরণ হয়নি। আলেপ্পোর ৯৮ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ এখন প্রেসিডেন্ট বাশারের সরকারি বাহিনীর হাতে।
৪ কোটি ৮০ লাখ মানুষের দেশ সিরিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধে গত পাঁচ বছরে মারা গেছে প্রায় ৫ লাখ মানুষ। অধিকাংশই নিরীহ বেসামরিক নারী-পুরুষ-শিশু। দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে প্রায় ৮৫ লাখ। প্রায় পুরো দেশটাই এক ভয়াবহ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কয়েক শ সশস্ত্র গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে গেছে সিরীয় জাতি; ইসলামিক স্টেটের ‘খিলাফতে’ যোগ দিতে সারা দুনিয়া থেকে এসেছেন অন্তত ১০ হাজার জিহাদি তরুণ-যুবক। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বৃহত্তর অংশ শুধু যে বাশারের সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধেই যুদ্ধ
করছে তা নয়, আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে তারা পরস্পরকেও হত্যা করছে। শিয়া, সুন্নি, আলাভি, কুর্দি, বিভিন্ন বেদুইন জনগোষ্ঠী পরস্পরকে শত্রুজ্ঞান করছে। সব সামাজিক ও মানবিক সম্পর্ক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী অপূর্ব সুন্দর দেশ সিরিয়ায় মাত্র ছয় বছর আগেই যে শান্তি ও স্থিতি ছিল, খুব সমৃদ্ধি না হলেও যে সচ্ছলতা ছিল, তার তুলনায় আজকের পরিস্থিতি এককথায় নরকতুল্য।
সিরিয়ার জনগণের এই অপরিমেয় ক্ষয়ক্ষতির জন্য কেউ চূড়ান্ত মাত্রায় সংক্ষুব্ধ হতে পারে। কিন্তু সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সে জন্য প্রতিশোধ নিতে চড়াও হলেন একজন রুশ কূটনীতিকের প্রাণের ওপর—এই ঘটনার মধ্যে সব ব্যাখ্যা মেলে না। কারণ, সিরিয়ার এই মর্মান্তিক পরিণতির জন্য পুতিনের রাশিয়া যতটা দায়ী, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি দায়ী ওবামা-হিলারির আমেরিকা, বাদশা সালমানের সৌদি আরব, বাদশা দ্বিতীয় আবদুল্লাহর জর্ডান, ডেভিড ক্যামেরনের যুক্তরাজ্য, ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদের ফ্রান্স, এমনকি রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের তুরস্কও। পেন্টাগন হিসাব দিয়েছে, সিরিয়ায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর পেছনে আমেরিকা একাই খরচ করেছে ৫৫ কোটি মার্কিন ডলার। আসলে ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দুনিয়ায় যে তথাকথিত ‘আরব বসন্ত’ শুরু হয়েছিল, তার পেছনে সমস্ত কলকাঠি নেড়েছিল আমেরিকা—এটা আমেরিকান সংবাদমাধ্যমের সূত্রেই সবাই জেনেছে। সেই ‘বসন্তের’ বাতাস সিরিয়ায় পেঁৗছাতে কিছুটা দেরি হয়েছিল, কিন্তু যখন পেঁৗছেছে, তখন তাতে ইন্ধন জোগাতে ওবামা-হিলারি এক মুহূর্তও দেরি করেননি।
রাষ্ট্রদূতের ওপর গুলি চালানোর সময় তিনি আইএস যোদ্ধাদের মতো ‘আল্লাহু আকবর’ বলে হুংকার ছেড়েছিলেন। কিন্তু আইএস বা অন্য কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠী এখন পর্যন্ত এ হত্যাকাণ্ডের দায় নিজের কাঁধে তুলে নেয়নি। ওই যুবক একজন পুলিশ কর্মকর্তা, কিন্তু ঘটনার সময় তিনি কর্তব্যরত ছিলেন না। হত্যাকাণ্ডটি তিনি একাই ঘটিয়েছেন, নাকি তাঁর পেছনে কোনো গোষ্ঠী ছিল—এ ব্যাপারে নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি।
তবে তুর্কি গোয়েন্দারা ও এরদোয়ানের ভক্তরা নাকি বলেছেন যে ওই যুবকের সঙ্গে আমেরিকা-প্রবাসী তুর্কি ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনের যোগাযোগ ছিল। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিরুদ্ধে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের নেপথ্যে এই গুলেনের হাত ছিল এবং মার্কিন গোয়েন্দারা এই গুলেনকে দেখভাল করছেন—খোদ প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এমন অভিযোগ করেছিলেন।
তুরস্কের মাটিতে এক তুর্কি পুলিশ কর্মকর্তার হাতে রুশ রাষ্ট্রদূতের হত্যা রুশ-তুর্কি সম্পর্কের গুরুতর অবনতি ঘটাতে পারে—পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে কেউ কেউ এমন কথা লিখেছেন। কিন্তু ঘটনা ঘটার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রুশ ও তুর্কি সরকারের যে প্রতিক্রিয়ার খবর পাওয়া গেল, তাতে মনে হয়, উল্টোটাই ঘটতে যাচ্ছে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান একটুও দেরি না করে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ফোন করেছিলেন। তিনি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে পুতিনকে অবহিত করেছেন এবং বলেছেন, ‘এই ঘটনা তুর্কি-রুশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপর দাগ ফেলতে পারবে না।’ কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভরোভ হত্যাকাণ্ডের জন্য তুরস্কের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেননি। বরং তাঁরা বলেছেন, এটা তৃতীয় কোনো পক্ষের ‘প্রভাকাৎসিয়া’ (উসকানি)। অর্থাৎ রুশ কর্তৃপক্ষের এই ভাষ্য অনুযায়ী, রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সুসম্পর্ক পুনরুদ্ধারের যে প্রক্রিয়া চলছে, তা ভণ্ডুল করে দিতেই তৃতীয় কোনো পক্ষ এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
আমাদের মনে আছে, গত বছর ডিসেম্বরে তুর্কি বিমানবাহিনী সিরীয়-তুর্কি সীমান্তের আকাশে রুশ বিমানবাহিনীর একটা যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার পর রুশ-তুর্কি সম্পর্ক ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে তুরস্কের অবস্থান পরিবর্তনের পর তাদের সম্পর্ক আবার জোড়া লাগে; বস্তুত তুরস্ক, ইরান ও রাশিয়া বাশার আল-আসাদের ক্ষমতাচ্যুতি এড়িয়ে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের একটা পরিণতি টানার চেষ্টা করছে। তাদের এই প্রচেষ্টার পাশাপাশি সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ বিমানবাহিনীর সহযোগিতায় বাশারের সরকারি বাহিনীর ক্রমবর্ধমান হারে নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ফলে আমেরিকা ও তার আরব মিত্ররা (সৌদি আরব,
জর্ডান, কাতার) সিরীয় গৃহযুদ্ধে একরকম গৌণ পক্ষে পরিণত হয়েছে।
এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞ এ জন্য যে গত বছরের ১৫ জুলাই তাঁর বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের সময় রাশিয়া তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিল। সিরিয়ার তারতুসে রুশ নৌঘাঁটিতে অবস্থানরত রুশ গোয়েন্দারা তুরস্কের ইনজিরলিক বিমানঘাঁটিতে অবস্থানরত তুর্কি সামরিক বাহিনীর ষড়যন্ত্রকারী সেনাকর্তাদের কথোপকথন ইন্টারসেপ্ট করে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে তাঁর বিরুদ্ধে কিছু একটা ঘটানোর চেষ্টা চলছে। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক আরও উন্নত হয় এবং আমেরিকার সঙ্গে তার উল্টোটা ঘটতে থাকে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বিশ্বাস করেন, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পেছনে মার্কিন কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন মহলের হাত ছিল।
মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক রাজনীতিতে তুরস্কের এখন রাশিয়ার পাশে থাকা যতটা লাভজনক হতে পারে, আমেরিকা ও তার মিত্রদের সঙ্গে থাকা ততটাই ক্ষতিকর হতে পারে। আমেরিকা ও সৌদি আরব খুব চেষ্টা করছে সিরিয়া ও ইরাকের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে পৃথকভাবে আরও শক্তিশালী করতে, যেন ওই দুটি দেশে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি প্রলম্বিত হয়। বিশেষত, কুর্দিদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য-সহযোগিতা মাত্রাতিরিক্ত। আর এই কুর্দিদের নিয়েই এখন তুরস্কের সবচেয়ে বেশি ভয়।
তাহলে তুরস্কের মাটিতে রুশ কূটনীতিকের এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যদি বড় কোনো শক্তির হাত থেকে থাকে, তাহলে সেটা
কার হতে পারে? প্রেসিডেন্ট পুতিন যে তৃতীয় পক্ষের ‘প্রভাকাৎসিয়া’র অভিযোগ করেছেন, তাঁর এক বন্ধু ও সিনিয়র সাংসদ সেই ‘তৃতীয় পক্ষের’ নাম উচ্চারণ করেছেন: ‘ন্যাটোর সিক্রেট সার্ভিস’।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ