দেড় হাজার শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: আশুলিয়ার জামগড়া এলাকার একটি কারখানায় হেলপার পদে কাজ করেন মহুয়া বেগম। মাস শেষে সব মিলিয়ে মজুরি পান সাড়ে ছয় হাজার টাকা। বাসা ভাড়া দিতেই ২ হাজার ৩০০ টাকা চলে যায়।
মহুয়া বেগম বললেন, ‘জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। বেতনের টাকায় সংসার চলে না। ২ টাকা বেতন দিয়ে ৫ টাকার কাজ করিয়ে নিচ্ছেন মালিকেরা। সরকারকে বুঝতে হবে, আমরা কষ্টে আছি। মজুরি বাড়ানো ছাড়া আর কোনো গতি নাই।’ তিনি বলেন, ‘দাবি মানলে কাজ করব। না হলে যেভাবে চলছে সেভাবেই চলবে।’
আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় গতকাল বুধবার মহুয়াসহ অর্ধশতাধিক পোশাকশ্রমিকের সঙ্গে
কথা হয়। তাঁদের অনেকেই দাবি না মানা পর্যন্ত কাজে যোগ না দিতে অনড়। তবে শ্রমিকদের একটি বড় অংশেরই আন্দোলনে সায় নেই। কারখানা খুলে দিলেই তারা খুশি।
টানা নয় দিনের শ্রম অসন্তোষের পর আশুলিয়ার ৫৫টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেন মালিকেরা। গত মঙ্গলবার কারখানা বন্ধের এই ঘোষণা দেয় তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। তবে গতকাল বুধবার বন্ধের তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয় চারটি কারখানা। শেষ পর্যন্ত সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৫৯-এ।
শ্রমিকেরা যাতে বিশৃঙ্খলা না করতে পারেন, সে জন্য গতকাল সকাল থেকেই আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চলে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়। কারখানার ফটকে মোতায়েন করা হয় বিপুলসংখ্যক পুলিশ। বিজিবি ও র্যাবের সদস্যরাও টহল দেন। আবদুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কে ভারী যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বন্ধ কারখানাগুলোর ফটকে সকালে অল্পসংখ্যক শ্রমিক ভিড় করলেও তাঁদের সরিয়ে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকিং করে শ্রমিকদের উদ্দেশে বাড়িতে অবস্থান করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। শ্রমিকেরা সংগঠিত হলে কিংবা বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি করা হয়। অবশ্য এসবের মধ্যেই সকালে নরসিংহপুর এলাকায় পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকেরা সংঘর্ষে জড়ান। উভয় পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। তবে হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
আশুলিয়ার জিরাবো থেকে বাইপাইল পর্যন্ত সব কারখানার ফটকেই বন্ধের নোটিশ দেখা যায়। তবে উইন্ডি অ্যাপারেলসের ফটকে বন্ধের নোটিশের পাশাপাশি ১২১ জন শ্রমিকের নাম, ছবিসহ কয়েকটি তালিকা দেখা গেছে। এই শ্রমিকদের সাময়িক বরখাস্ত করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এই কারখানা থেকেই গত সপ্তাহে শ্রমিকদের আন্দোলন শুরু হয়।
এদিকে আশুলিয়ায় শ্রম অসন্তোষের ঘটনায় তিনটি কারখানা কর্তৃপক্ষ অন্তত দেড় হাজার শ্রমিকের বিরুদ্ধে কারখানা ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগে পৃথক মামলা করেছে। দুই শ্রমিককে গ্রেপ্তারও করেছে আশুলিয়া থানার পুলিশ।
ফাউন্টেন গার্মেন্টস ও উইন্ডি অ্যাপারেলস কর্তৃপক্ষ আশুলিয়া থানায় ৩৯ জন শ্রমিকের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও প্রায় ২০০ জনকে আসামি করে মামলা করেছে। কারখানা ভাঙচুর, লুটপাট ও মারধরের অভিযোগে উইন্ডির সহকারী মহাব্যবস্থাপক মাসুদ রানা গতকাল ও ফাউন্টেনের কর্মকর্তা নাজমুল হক গত মঙ্গলবার মামলা করেন। হা-মীম গ্রুপের পক্ষ থেকেও এক হাজারের বেশি শ্রমিকের বিরুদ্ধে গতকাল একই ধরনের মামলা করা হয়েছে বলে জানান আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহসিনুল কাদের।
এ ছাড়া উইন্ডি অ্যাপারেলসের মাসুদ ও সায়েম নামের দুই শ্রমিককে গতকাল গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক মাসুদ মিয়া গত রাতে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে বিভ্রান্তি: নরসিংহপুরে রাশেদুল ইসলাম নামের এক শ্রমিক বলেন, ‘সরকার থেকে আগে বলা হয়েছে তিন বছর পর মজুরি বাড়বে। এখন বলছে বাড়বে না।’ সরকার কবে বলেছে জানতে চাইলে তিনি সুনির্দিষ্ট করে এ বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি।
আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় রাশেদুলসহ বেশ কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের প্রায় সবারই ধারণা, আইন অনুযায়ী তিন বছর পর পর মজুরি বাড়বে। তাই মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনটিকে যৌক্তিক মনে করেন তাঁরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সপ্তাহ দু-এক আগে একটি শ্রমিক সংগঠনের সম্মেলন হয় জামগড়া এলাকায়। সেখানে সংগঠনের নেতারা ন্যূনতম মজুরি ১৫ হাজার টাকা করার দাবি জানান। অন্যদিকে ১২টি শ্রমিক সংগঠনের জোট গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা কয়েক মাস ধরে ন্যূনতম মজুরি ১৬ হাজার (মূল বেতন ১০ হাজার) টাকা করার বিষয়ে দাবি তুলতে শ্রমিকদের সঙ্গে ঘরোয়াভাবে আলাপ-আলোচনা করেন।
শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, ছাঁটাই হলে ন্যায্য প্রাপ্য দেওয়া, দুপুরের খাবার ও রাত্রিকালীন কাজের ভাতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবিতে গত সপ্তাহে আশুলিয়ার কয়েকটি কারখানায় আন্দোলনে নামেন শ্রমিকেরা। সেই দাবি পূরণ না হওয়ায় তা অন্য কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে। একই সঙ্গে মজুরি বাড়ানোর বিষয়টি শ্রমিকদের এক নম্বর দাবিতে পরিণত হয় বলে জানান একাধিক শ্রমিক সংগঠনের নেতারা।
জানতে চাইলে গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের সমন্বয়ক রফিকুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, ‘শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর দাবিটি যৌক্তিক। এ বিষয়ে আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। শ্রমিকদের সঙ্গে সাপ্তাহিক আলোচনায় আমরা বিচ্ছিন্নভাবে অবহিত করেছি।’
শ্রম আইন-২০০৬ অনুযায়ী পাঁচ বছর পর মজুরি বোর্ড গঠিত হওয়ার কথা। তবে তিন বছরের মধ্যে মজুরি কাঠামো সংশোধনের সুযোগ আছে। সর্বশেষ ২০১৩ সালে পোশাকশিল্পের মজুরি বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী মজুরি বোর্ড গঠিত হওয়ার এক থেকে তিন বছরের মধ্যে পুনর্বিবেচনার সুযোগ আছে। ফলে নতুন করে বাড়তি মজুরি চাওয়া যাবে না, বিষয়টি তেমন নয়। তবে চাওয়ার ধরনটি নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে।
গত সোমবার রাতে ঢাকায় নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের বাসায় শ্রমিক, মালিক ও সরকারের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। এতে সিদ্ধান্ত হয় মঙ্গলবার থেকে শ্রমিকেরা কাজে যোগ দেবেন। তবে পরদিন শ্রমিকেরা কাজ না করলে কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেয় মালিকপক্ষ।
বিষয়টি উল্লেখ করে সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিজিএমইএর নেতারা শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে আরেকটু সময় দিতে পারতেন। তিনি বলেন, কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্তটি শিশুসুলভ হয়েছে। কারখানা খুলে দেওয়ার পাশাপাশি বেতন বন্ধ না করা ও মজুরির বিষয়ে আলোচনা করলে বর্তমানের সমস্যাটি সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ নাছির বলেন, মজুরি বাড়ানোর প্রশ্নই ওঠে না। কর্মপরিবেশ উন্নয়ন করতে গিয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচ হচ্ছে। ইতিমধ্যে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সে জন্য বেতন বাড়ানোর কথা বললেই তো হবে না। মালিকদের সেই সক্ষমতা তো থাকতে হবে।
শ্রমিকেরা বিক্ষুব্ধ, চিন্তিত: জামগড়া এলাকায় ১০ বাই ১২ ফুটের ছোট্ট একটি ঘরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন জাহিদ ইসলাম। কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চিন্তিত তিনি। বললেন, ‘কারখানা না খুললে সংসার চলবে কীভাবে মাথায় আসছে না। ধর্মঘট করি নাই। কারখানার সবাই কাজ থেকে বেরিয়ে গেছে, তাই বাধ্য হয়ে আমিও বের হয়ে এসেছি।’
কারখানা খুললেই কাজে যোগ দেবেন, এমনটাই জানালেন জাহিদ। তবে মজুরি বাড়ানোর আন্দোলনেও সায় আছে তাঁর। বললেন, ‘সরকারের দেখা উচিত, দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। বেতন বাড়ছে না। আমরা কীভাবে চলব?’
ডংলিয়ং ফ্যাশনের এক শ্রমিক বললেন, ‘অন্য কারখানায় ঝামেলা হওয়ার কারণে শনিবার দুপুরের খাবারের পর কারখানা বন্ধ করে দেন কর্মকর্তারা।’ আন্দোলনের বিষয়ে তিনি বললেন, ‘প্রতিবছরই বাড়িভাড়া বাড়ে। নিয়ম অনুযায়ী বছরে যে ২০০-২৫০ টাকা বেতন বাড়ে, তা বাড়িভাড়ার পেছনেই চলে যায়। সে জন্য অবশ্যই বেতন বাড়ানো দরকার।’
এনভয় গ্রুপের কারখানার এক শ্রমিক বললেন, ‘বেতন না পেলে সংসার কীভাবে চলবে, সেটি নিয়ে চিন্তায় আছি।’ দাবি আদায় না হলেও কারখানার কাজে যোগ দিতে তাঁর কোনো আপত্তি নেই বলে জানালেন।
সর্বশেষ মজুরি বাড়ানোর পর কারখানার কর্মকর্তারা টার্গেট (প্রতি ঘণ্টায় কাপড় সেলাইয়ের লক্ষ্য) বাড়িয়ে দিয়েছেন। টার্গেট পূরণ না করতে পারলে গালিগালাজ করেন। সে জন্য ঠিকমতো পানি খেতে কিংবা বাথরুমে যেতে পারেন না শ্রমিকেরা। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন—এমন অভিযোগও করলেন নাজমা আক্তার নামের একজন শ্রমিক। তারপরও কাজে যোগ দিতে চান নাজমা আক্তার। সে ক্ষেত্রে তাঁর আরজি, অল্প কিছু বেতন যেন বাড়ানো হয়। বললেন, ‘বিচার-বিবেচনা করে কিছু টাকা বেতন বাড়ালে আমরা বেঁচে যাই।’
শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনার পর গত সোমবার রাতে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ঘোষণা দেন, আশুলিয়া এলাকায় তিন বছর বাসা ভাড়া বাড়বে না। তবে শ্রমিকদের অনেকেই এই আশ্বাস বিশ্বাস করতে পারছেন না। তাঁরা মনে করছেন, আন্দোলন থামাতেই এমন ঘোষণা।
স্টারলিং ক্রিয়েশনের এক শ্রমিক বললেন, ‘সরকার তো আর বাড়ি বানিয়ে দেয় নাই। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়াবেই। সরকার আটকাবে কীভাবে? আমরা প্রতিবাদ করলেই বাড়িওয়ালা আমাদের বের করে দেবে।’
শ্রমিকেরা অনেক সময়ই স্থানীয় মুদিদোকান থেকে বাকিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনেন। মাস শেষে বকেয়া টাকা পরিশোধ করেন। বেরন এলাকার আনিসুর রহমান নামের এক মুদিদোকানি বলেন, শ্রমিকদের মাসে ৬০ হাজার টাকার মতো বাকি দেন। তবে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি এখন আর বাকিতে দেবেন না।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখ্তার বলেন, কারখানাভিত্তিক শ্রমিকদের বেশ কিছু দাবিদাওয়া ছিল। সেগুলো মেনে না নেওয়ার ফলে সমস্যা জটিল পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে।
এ বিষয়ে বিজিএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ নাছির বলেন, ‘কারখানার অভ্যন্তরে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে আমরা প্রতিনিয়তই এসব সমস্যার সমাধান করছি।’
এদিকে গাজীপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে গতকাল। শিল্পাঞ্চল পুলিশ-২ গাজীপুরের পরিচালকের নলজানি এলাকার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই সভায় বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ছাড়াও মজুরি কমিশন গঠন ও শ্রমিক ইউনিয়ন বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়।