রোহিঙ্গারা তবে যাবে কোথায় ?
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: রোহিঙ্গারা যেন মানুষ নয়, বছরের পর বছর ধরে তারা যে দুর্দশার মধ্যে টিকে আছে, তা দেখে এমনটাই মনে হয়। মিয়ানমার সরকার তাদের অব্যাহতভাবে নিপীড়ন করছে, এরপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে তারা ঘোষণা দিয়েছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আদি অধিবাসী নয়। এ দাবির সত্যতা প্রমাণের জন্য দেশটির ধর্ম মন্ত্রণালয় তথ্য ও প্রমাণ নিয়ে ইতিহাসগ্রন্থ লেখার পরিকল্পনা করছে। নতুন ইতিহাস রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়েই লেখা হবে।
দাবিটি এক কথায় হাস্যকর। কারণ, পৃথিবীতে অভিবাসন ব্যাপারটি মানবসভ্যতার প্রায় সমবয়সী। একসময় মানুষ স্বাধীনভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গেছে। তখন তো আর জাতিরাষ্ট্র ছিল না, ফলে মানুষ অবাধে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেত। এই সংমিশ্রণের মধ্য দিয়েই সভ্যতা বিকশিত হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে কে কোথাকার আদি বাসিন্দা, এ দাবির ভিত্তি নেই। ইতিহাস বলে, স্বাধীন আরাকান রাজ্যে অষ্টম শতাব্দীতে মুসলমানরা এসেছিল। এরা ছিল মূলত সমুদ্রচারী মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ। তাদের সঙ্গে সপ্তদশ শতাব্দীতে বাঙালি মুসলমানরা যোগ দেয়। ধাওয়া খেয়ে তারা আরাকানের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য হয়। অনেককে দাস হিসেবে আরাকানে আনা হয়। এরপর ১৭৮৫ সালে বার্মিজ সেনাবাহিনী আরাকান দখল করে নেয়। অর্থাৎ, প্রায় ১ হাজার ৩০০ বছর ধরে মুসলমানরা এই অঞ্চলে বসবাস করছে। অথচ এখন মিয়ানমারের সরকার বলছে, তারা এখানকার আদি বাসিন্দা নয়। তারা যদি এখানকার আদি বাসিন্দা না হয়, তাহলে আরাকানের আদি বাসিন্দা কারা, সে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। খোঁজ নিলে জানা যাবে, যারা নিজেদের মিয়ানমারের আদি বাসিন্দা বলে দাবি করছে, তারাও একদিন আরেক জায়গা থেকে এসে সেখানে বসতি স্থাপন করেছিল।
একটি ভূখণ্ডে একদল মানুষ ১ হাজার ৩০০ বছর ধরে থাকার পরও যদি বলা হয়, তারা ওখানকার আদি বাসিন্দা নয়, তাহলে সেটা হয় সত্যের অপলাপ। আধুনিক জাতিরাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ভাষিক গোষ্ঠীর মানুষ একত্রে বসবাস করবে, সেটাই রীতি। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকবে, স্বার্থের সংঘাত থাকবে, কিন্তু তারপরও একটি ঐক্যের সূত্র থাকবে। তা না হলে একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়, মিয়ানমারের সরকার ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী সে সত্যকে ভুলতে বসেছে।
মিয়ানমারের রাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। তবে দেশটির সচেতন নাগরিকেরা যে এর জোরালো প্রতিবাদ করছেন, তাও নয়। ধারণা করা যায়, মিয়ানমারের সাধারণ মানুষের মধ্যেও রোহিঙ্গাদের প্রতি বিতৃষ্ণা রয়েছে। এই বলদর্পী জাত্যভিমান কাজের কথা নয়, এটা মানুষকে অন্ধ করে দেয়, এ কারণে মানুষের বিচার, বুদ্ধি ও বিবেচনা লোপ পায়। আজকের বিশ্বায়নের যুগে তা কাম্য নয়, আবার বিশ্বায়নের পরিণতি হিসেবেও জাত্যভিমান বাড়ছে। এ জিনিস আগেও ছিল, যা এখন নতুন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে। ব্রিটেনের ব্রেক্সিট ও যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয় সেই জাত্যভিমানের ফসল। মোদ্দা কথা হলো, বর্মিরা সম্ভবত চাইছে রোহিঙ্গারা অন্যত্র চলে যাক। তাদের ‘প্রকৃত ইতিহাস’ লেখার প্রকল্প তারই ইঙ্গিত বহন করে। অর্থাৎ, তারা এথনিক ক্লিনজিংয়ের চেষ্টা করছে।
নিপীড়িত ও ভাগ্যাহত এসব মানুষ যখন মার খেয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে, আমরা তখন তাদের মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিচ্ছি। আমাদের গণমাধ্যমের একাংশ এমনভাবে সংবাদ প্রতিবেদন করছে যে মনে হয়, অভিবাসনপ্রত্যাশী এসব মানুষ দাগি অপরাধী। তাদের ঢুকতে না দিয়ে বাংলাদেশ মহান কাজ করেছে। এটা ঠিক, তাদের আশ্রয় দেওয়া হলে হয়তো নানা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হবে, কিন্তু মানুষকে এভাবে আশ্রয়চ্যুত করা চরম অমানবিক। এর জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক মতৈক্য। প্রয়োজনে নিপীড়নকারী রাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। সম্প্রতি ঢাকায় গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (জিএফএমডি) সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। তারা এই লোকজনের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে লেগে থাক, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। অভিবাসনপ্রত্যাশীরাও মানুষ—এই সত্য ভুললে ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস বৃথা যাবে।