২০১৬: ব্যাংকের নানা কীর্তি
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: ২০১৬ সাল ছিল দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য অশুভ বছর। আর্থিক জালিয়াতির পাশাপাশি এ বছরে ব্যাংকগুলোতে তথ্যপ্রযুক্তির নিরাপত্তার বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচনায় আসে। রিজার্ভ চুরির ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই বেসরকারি খাতের তিন ব্যাংকের কার্ড জালিয়াতি করে টাকা তুলে নেওয়া হয়। দুটি ঘটনাতেই সরাসরি বিদেশিদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। ২০১৬ সালে খেলাপি ঋণও লাগামহীন বাড়তে থাকে। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগের পর দুর্বল হয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। যার প্রভাবে পুরো ব্যাংক খাত হয়ে পড়েছে নিয়ন্ত্রণহীন।
বিশ্বের বড় সাইবার চুরি: গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়। এ ঘটনায় দায় স্বীকার করে পদত্যাগে বাধ্য হন তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান। সরিয়ে দেওয়া হয় দুই ডেপুটি গভর্নরকেও। চুরি হওয়া অংশের কিছু ফেরত পাওয়ার পর বাকি রয়েছে ৬ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। তা ফেরত পাওয়া নিয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টও আলোর মুখ দেখেনি। বাংলাদেশ দায়ী করছে বিদেশিদের আর তারাও বাংলাদেশের ওপর দায় চাপাচ্ছে। রিজার্ভ চুরির ঘটনা এখন সারা বিশ্বে বড় সাইবার চুরি হিসেবে পরিচিত।
এটিএম কার্ড জালিয়াতি আতঙ্ক: ব্যাংকে লাইন দেওয়ার পরিবর্তে সহজেই টাকা তুলতে গ্রাহকেরা এটিএম ব্যবহার করছেন। তবে ৬ ফেব্রুয়ারি তিন ব্যাংকের কার্ড জালিয়াতির ঘটনা সবার মাঝে ভীতি ছড়িয়ে দেয়। এদিন বেসরকারি খাতের ইস্টার্ন, সিটি ও ইউসিবিএলের চার এটিএম বুথে স্কিমিং মেশিন দিয়ে কার্ড জালিয়াতি করা হয়। পরে নতুন কার্ড তৈরি করে গ্রাহকের হিসাব থেকে টাকা তুলে নেয় বিদেশিরা। এ ঘটনায় বিদেশিদের পাশাপাশি ব্যাংক কর্মকর্তাদেরও সম্পৃক্ততা পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এমডিকে অপসারণ, ভারপ্রাপ্ত এমডি আটক: ২০১৫ সালের পর ২০১৬ সালেও অগ্রণী ব্যাংক নিয়ে বিপাকে ছিল অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক। আমানতকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করায় গত ২৯ জুন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ আবদুল হামিদকে অপসারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাঁর বিরুদ্ধে ৯০৬ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগ আনা হলেও পরে ৭৯২ কোটি টাকা অনিয়মের জন্য অভিযোগ গঠন করা হয়। এমডিকে অপসারণের পর অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ৩০ জুন জ্যেষ্ঠ ডিএমডি মিজানুর রহমান খানকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এমডির দায়িত্ব দেওয়া হয়। সকালে দায়িত্ব পাওয়ার পর বিকেলে দুর্নীতি দমন কমিশন তাঁকে আটক করে।
লাগামহীন খেলাপি ঋণ: খেলাপি ঋণ এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে ২০১৫ সালে নানা উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণ নীতিমালা ও তদারকি করার কথা থাকলেও নিজেই গ্রাহকদের ঋণ পুনঃ তফসিল করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান নিজের গ্রুপের ঋণে বিশেষ সুবিধা দাবি করলে ২০১৫ সালে ৫০০ কোটি টাকার বেশি সব গ্রহীতার জন্যই ঋণ পুনর্গঠন নীতিমালা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সময়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিশেষ সুবিধায় পুনর্গঠন করা হয়। ফলে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ কমে আসে। তবে ২০১৬ সালের জানুয়ারি-জুন সময়েই খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ১১ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা। ফলে গত জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৩ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৬৫ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। এ ছাড়া অবলোপন করা হয় ৪২ হাজার ৩২১ কোটি টাকার ঋণ। দুটোকে হিসাবে নিয়ে ২০১৬ সালে ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ।
দুর্বল কেন্দ্রীয় ব্যাংক: রিজার্ভ চুরির ঘটনায় আতিউর রহমানের পদত্যাগের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর করা হয় সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবিরকে। এরপর থেকে স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বকীয়তা হারাতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর ওপর দুর্বল হয়ে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, বিশেষ করে সাবেক আমলা ও রাজনীতিবিদদের ব্যাংকগুলোর ওপর। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে আনা শুরু করেছেন নতুন গভর্নর। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। নিজেদের সুবিধা কমে আসা ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারানোর ফলে হতাশ হয়ে পড়ছেন দক্ষ কর্মকর্তারা।