পরিবারের সুখ ফেরাতে পারলেন না রহিম
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: পরিবারের অভাব ঘুচিয়ে সুখ-শান্তি ফেরাতে হবে। একটা সুন্দর বাড়ি তৈরি করতে হবে। সেখানে পরিবারের সদস্যরা হাসিমুখে থাকবেন। শিশুসন্তান আহনাফ ভালো স্কুলে পড়াশোনা করবে। এসব স্বপ্নে বিভোর থাকতেন আবদুর রহিম। স্বপ্নপূরণের আশায়, পরিবারের সুখ ফেরানোর আশায় একদিন সেনাবাহিনীর হয়ে শান্তি রক্ষায় আফ্রিকা গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তবুও পরিবারের অভাব ঘুচিয়ে শান্তি ফেরাতে পারলেন না রহিম। পারলেন না নিজের ও পরিবারের সদস্যদের দেখানো স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে।
সাতক্ষীরা শহরের হাজীপুর গ্রামে আজ শুক্রবার এভাবেই বিলাপ করতে করতে ছেলে আবদুর রহিমের স্বপ্নের কথা বলছিলেন তাঁর মা রওশনারা বেগম। বলছিলেন, রহিম যেমন স্বপ্ন দেখতেন, ঠিক একইভাবে পরিবারের সদস্যদেরও স্বপ্ন দেখাতেন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার সেন্ট্রাল আফ্রিকায় শান্তিরক্ষা মিশনে থাকা অবস্থায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন রহিম।
দিনমজুর আবদুল মাজেদের ছেলে আবদুর রহিম (৩০)। নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর মতো পরিবারে চরম অভাব-অনটনের মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় রহিম ২০০৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কিন্তু এতেও পরিবারের অবস্থার কোনো উন্নতি করতে পারেননি। মানসিক প্রতিবন্ধী ছোট ভাই আবদুল করিমের চিকিৎসার পেছনেই ব্যয় করতে হয়েছে সব আয়। এ অবস্থায় ২০১২ সালে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার রাজবাড়িয়া গ্রামের রাবেয়া সুলতানাকে তিনি বিয়ে করেন। গত বছর আগস্টে তিনি ছেলেসন্তানের বাবা হন। তাঁর শিশুসন্তানের নাম আহনাফ-আল-ফারাবি।
আজ বেলা তিনটায় সাতক্ষীরা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে হাজীপুর গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের একটি কুঁড়েঘরে আবদুর রহিমের পরিবার বস করে। ঘরের সামনে বসে বিলাপ করছেন তাঁর স্ত্রী রাবেয়া সুলতানা ও মা রওশনারা বেগম। পাশে ভিড় করে আছেন প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনেরা। তাঁদের সবার একটাই চিন্তা, এখন কী হবে এই পরিবারের। কীভাবে চলবে তাঁদের আগামী দিনগুলো।
নিহত রহিমের বাবা আবদুল মাজেদ বলেন, তাঁর সম্পত্তি বলতে এক বিঘা ফসলি জমি ও দুই কাঠা জমির ওপর এই কুঁড়েঘর। দিনমজুরের কাজ করে খেয়ে না-খেয়ে ছেলে রহিমকে পড়ালেখা শিখিয়েছেন। ছোট ছেলে করিম উচ্চমাধ্যমিকে পড়া অবস্থায় প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন। একমাত্র মেয়ে রেহেনা পারভিন এখন নবম শ্রেণিতে পড়ছে। রহিম সেনাবাহিনীতে চাকরি পাওয়ার পর ভেবেছিলেন, সুখের সুবাতাস বইবে পরিবারে। কিন্তু গতকাল রাতে খবর আসে, সন্ত্রাসীদের গুলিতে রহিম নিহত হয়েছেন। আর কিছু বলতে পারেন না তিনি। নাতি আহনাফের মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবতে থাকেন মাজেদ।
মা রওশনারা বেগম বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘বাবা, তুই আমারে কত স্বপ্ন দেখিয়েছিলি। বাড়ি করবি। বোনের বিয়ে দিবি। আফ্রিকা থেকে বাজার করে নিয়ে আসবি। আমাদের আর কষ্ট থাকবে না। আরও কত কিছু।’ এসব বলার একপর্যায়ে ছেলের শোকে অচেতন হয়ে পড়েন তিনি।
নিহত রহিমের শ্যালক শরিফুল ইসলাম বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর ভগ্নিপতির সহকর্মীরা সেন্ট্রাল আফ্রিকা থেকে মোবাইল ফোনে তাঁকে জানিয়েছেন, রহিমকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করেছে। তিনি আরও জানান, ঢাকা সেনানিবাস থেকে মেজর ফাহিম তাঁকে জানিয়েছেন, রহিমের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তরের দুদিন আগে তাঁদের জানানো হবে। তবে রহিমের মরদেহ দ্রুত বাড়িতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছে তাঁর পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীরা।
নিহত রহিমের স্ত্রী রাবেয়া সুলতানা স্বামীর শোকে নির্বাক হয়ে আছেন। ছেলে আহনাফকে কোলে নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন অজানা শঙ্কায়। মায়ের কোলে থাকা শিশু আহনাফ জানে না, তার বাবা শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। সে জানে না, সে আর কাউকে কোনো দিন ‘বাবা’ বলে ডাকবে না।