গ্যাং কালচারের নামে ভয়ংকর হয়ে উঠছে যে কিশোরেরা

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: ‘গ্যাং কালচারের’ নামে দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে রাজধানীর উত্তরা এলাকার কিশোরদের একটা অংশ। ‘নাইন স্টার’ ও ‘ডিসকো বয়েজ’ নামে সক্রিয় এসব কিশোর শুরুতে মূলত ‘পার্টি’ করা, হর্ন বাজিয়ে প্রচণ্ড গতিতে মোটরসাইকেল চালানো ও রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার কাজে যুক্ত ছিল। বছর খানেক ধরে তারা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িত হয়েছে, যার সর্বশেষ শিকার উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির।
এসব কিশোর এতটাই বেপরোয়া যে গত শুক্রবার আদনানকে হত্যার জন্য বের হওয়ার আগে তারা ফেসবুকে গ্রুপ ছবি পোস্ট করে যায়। ছবিতে তাদের সবাইকে নীল রঙের পোশাকে দেখা গেছে। কারও কারও হাতে ছিল হকিস্টিক। আদনানের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পর এক কিশোর পাল্টা স্ট্যাটাস দিয়েছে, ‘ভাই তোর খুনিগো বাইর কইরা জবাই দিমু’।
এসব কিশোর অপরাধী ‘গ্যাংয়ের’ ব্যাপারে তাদের অভিভাবক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবাই ছিলেন উদাসীন। উত্তরার ১৯ নম্বর সেক্টরের একাধিক বাসিন্দা বলেছেন, বছর দুয়েক ধরে তাঁরা এসব কিশোর বখাটের উৎপাত দেখে আসছেন। তাদের উচ্চগতির মোটরসাইকেলের রেস পথচারীদের আতঙ্কের কারণ ছিল।

নিহত আদনান কবিরের বাবা কবির হোসেন উত্তরা পশ্চিম থানায় যে মামলা করেছেন, তাতেও ছেলের খুনের কারণ হিসেবে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ‘গ্রুপিংয়ের’ কথা উল্লেখ করেছেন। যদিও আদনান কোনো ‘গ্যাংয়ের’ সদস্য ছিল না বলে দাবি করেন তার বাবা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব গ্যাং মূলত ‘পার্টি’ বা ফুর্তির আয়োজন করে, হর্ন বাজিয়ে প্রচণ্ড গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে ও মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে দাপট দেখায়। এই দুই দলের সদস্যদের বয়স ১৪ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। এদের বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের পরিবারের সন্তান ও স্কুলছাত্র। নিম্ন মধ্যবিত্তের ও লেখাপড়া না করা কিশোর-তরুণও আছে।

তবে দুই দলের প্রধানের বয়স কুড়ি-বাইশ বছর। এর মধ্যে নাইন স্টার গ্রুপের (ফেসবুক আইডি—নাইনএমএম বয়েজ) প্রধান রাজুর বয়স আনুমানিক ২০ বছর। তাঁর বাবা একসময় তালাচাবি সারাতেন। রাজু নিজেও বাবার সঙ্গে কিছুদিন একই কাজ করেছেন। তাই তাঁর নাম হয়ে গেছে ‘তালাচাবি রাজু’।

ডিসকো বয়েজের ফেসবুকে (ফেসবুক আইডি—ডিসকো বয়েজ উত্তরা) নিজেদের পরিচয় দিয়ে ‘গ্যাংস্টার’ হিসেবে। এই গ্রুপের প্রধান হলেন ছোটন খান। উত্তরার বাসিন্দা হলেও অন্য এলাকার একটি কলেজে ভর্তি হয়ে আছেন ছোটন। এলাকার লোকজন তাঁকে ছিনতাইকারী হিসেবেও জানে।

দুই গ্রুপের দুই প্রধান কারও শিক্ষাগতযোগ্যতা কিশোরদের আকৃষ্ট করার মতো নয়। তারপরও উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উত্তরা হাইস্কুল, নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ উত্তরা এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাঁদের দাপট রয়েছে।

উত্তরার তিনটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই ‘গ্যাং কালচারের’ শুরু কমপক্ষে দুই বছর আগে। শুরুর ‘ডিসকো বয়েজ উত্তরা’ নামে একটি দল ছিল। পরে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে ‘নাইন স্টার’ নামে আরেক গ্যাং তৈরি হয়। এর বাইরে উত্তরায় এলাকায় ছোট ছোট আরও কয়েকটি গ্রুপ পাড়াভিত্তিক সক্রিয় আছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন ছাত্র বলেছে, কেউ কেউ এলাকায় টিকে থাকতে এসব গ্যাংয়ে যুক্ত হয়। আবার কেউ কেউ এলাকায় দাপট দেখাতে বা ‘হিরোইজম’ প্রবণতা থেকেও যুক্ত হচ্ছে। দুটি গ্যাংই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়।

নিয়ন্ত্রণের ধরন কী, জানতে চাইলে এসব ছাত্র জানায়, ‘কখনো একটি দলের পাল্লা ভারী থাকে। যেই দলের পাল্লা ভারী থাকে সেই দলের ছেলেরা তখন বড় ভাই। তারাই খেলার মাঠের নিয়ন্ত্রণ, মোটরসাইকেল রেস ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। রাস্তায় রোমিওগিরি করে। তখন আরেক দল নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে। এ থেকে মারামারি হয়।’

একজন ছাত্র তার জামার হাতা উঠিয়ে এই প্রতিবেদককে লম্বা কাটা দাগ দেখায়। সে বলে, ‘খেলার মাঠে আমি ক্রিকেট বল ধরার সময় একজনের পায়ে পা লেগে যায়। আমি সরি বললাম। সঙ্গে সঙ্গে সে আমাকে বেয়াদব বলে গাল দেয়। বলে তাকে আমি অসম্মান করেছি। কিছুক্ষণ পর দলবল নিয়ে এসে লোহার স্কেল দিয়ে আমার হাত কেটে দেয়। অনেকগুলো সেলাই লাগে।’

এখন প্রশ্ন উঠছে, উত্তরার এই গ্যাং কালচার সম্পর্কে এক কিশোর খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত স্থানীয় বাসিন্দা বা পুলিশ কেউ কি কিছু জানতে পারেনি? জানলে তাঁরা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন। আদনানের আত্মীয়স্বজন বলছেন, সে কখনো কোনো গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। তবে যেদিন খুন হয়, সেদিন তার সঙ্গে দুই বন্ধুর দেখা হয়। ওই বন্ধুরা নাইন স্টার গ্রুপের ছিল।

উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টর কল্যাণ সমিতির সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব‍.) মো. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘গ্যাং ছিল বলে জানি না। বখাটেদের উৎপাত আছে। যেদিন ওই ছেলেটি (আদনান) খুন হয়, তার কিছুক্ষণ পর আমি একটি দলকে হকিস্টিক নিয়ে মহড়া দিতে দেখি। আমি ভেবেছিলাম ওরাই হয়তো খুনটি করেছে, পরে শুনি এটা আরেকটা দল।’

মো. জাহিদ হোসেন জানান, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনা প্রতিদিনই ঘটে। গত বছর আমের মৌসুমে যার যার বাড়িতে আম ধরেছিল তাদের বাড়ির দারোয়ানকে মারধর করে আম পেড়ে নিয়ে যায় এসব ছেলে।

১৩ নম্বর সেক্টরের যে জায়গায় আদনান খুন হয় সেখান থেকে অল্প দূরত্বে ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ। আদনান এই স্কুলেরই ছাত্র ছিল। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বশির উদ্দিন ভূইয়া বলেন, ‘আমরা শুধু দেখতাম ছেলেরা  হর্ন বাজিয়ে মোটরসাইকেল রেস দিচ্ছে। মাঝে মাঝে ছেলেগুলো গাড়ি নিয়েও আসত। কিন্তু এর মধ্য আমাদের ছেলেরা আছে, সে খবর জানা নেই।’

উত্তরা পুলিশের নথিপত্র বলছে, নাইন স্টার ও ডিসকো বয়েজের সদস্যদের মধ্যে সংঘাতের ঘটনায় গত আট মাসে পাঁচটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম তিনটি ঘটনা মারামারি। চতুর্থটি ছুরিকাঘাত। পঞ্চমটি খুনের।

উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-অপারেশনস) শাহ আলম বলেন, আট মাস আগে মারামারির প্রথম মামলা হওয়ার উত্তরা পুলিশ এই দুটি গ্যাংয়ের কথা জানতে পারে। তাঁর দাবি, ‘আমরা অপরাধীদের ধরেছি। মহামান্য আদালত জামিন দিয়ে দিয়েছে।’

দুই দলের সংঘর্ষের চতুর্থ ঘটনায় আহত হয়েছিলেন ‘নাইন স্টার’ গ্রুপের প্রধান রাজু ওরফে তালাচাবি রাজু (২০)। তাঁকে ছুরিকাহত করে প্রতিপক্ষ। ওই মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিল নাফিস মো. আলম ওরফে ডন নামে এক কিশোর। কিছুদিন পর জামিনে ছাড়া পায় সে। সর্বশেষ আদনান হত্যার মামলায় নাফিসকে আবার গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আদনান খুনের মামলার এজাহারভুক্ত নয়জন আসামির মধ্যে এখন পর্যন্ত দুজনকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে পুলিশ।

উত্তরা ট্রাস্ট স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবিরদের বাসা ১২ নম্বর সেক্টরে। সে গত শুক্রবার বিকেলে ১৩ নম্বরে সেক্টরে খেলতে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়। মাগরিবের আজানের কিছুক্ষণ পর পরিবার জানতে পারে সে খুন হয়েছে।

আদনান সেদিন অ্যাডিডাসের যে কালো ব্যাগটি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিল, তিন দিন ধরে সেই ব্যাগ বুকে চেপে বসে আছেন মা কাওসারা বেগম। তিনি বলেন, ‘এই ব্যাগ নিয়েই বেরিয়েছিল। সোয়েটার ছিল ভেতরে। নতুন ব্যাগ। এটা দিয়ে শুধু দুটো কোপ ঠেকাতে পেরেছে। ওরা আমার ছেলের মাথার পেছনে হকিস্টিক দিয়ে বাড়ি দিয়েছে। পড়ে যাওয়ার পর কুপিয়েছে। হাতের রগ কেটে ফেলেছে। স্ক্রু দিয়ে ছিদ্র করেছে পেট। মাংস খুবলে নিয়েছে। না জানি কতবার মা মা বলে ডেকেছে আমার বাচ্চাটা।’

আদনান নাইন স্টার গ্রুপের সদস্য ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুলিশ বলছে, আগে আদনান ডিসকো গ্রুপের ছেলেদের সঙ্গে মিশত। তাদের সঙ্গে ‘পার্টি’ করার ছবি পুলিশ সংগ্রহ করেছে। পরে হয়তো দল বদলেছে।

কিশোর-তরুণদের এভাবে বখে যাওয়ার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, ‘নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশে এই গ্যাং কালচার তৈরি হতে দেখা গেছে, যাকে আইনের ভাষায় বলা হয় জুভেনাইল সাবকালচার। অনেক সময় বঞ্চনা থেকে কিশোরদের মধ্যে এমন দল গড়ে ওঠে। আবার কোথাও কোথাও বীরত্ব দেখাতেও ছেলেরা “মাস্তানি”তে যুক্ত হয়। পাড়ায়-মহল্লায় আগেও এমনটা হতো। এখন সেটার সহিংস রূপ দেখতে পাচ্ছি।’ তিনি বলেন, খেলার মাঠে বা ছোটখাটো ঘটনায় কিশোরদের মধ্যে ঝগড়া হয়। কিন্তু সেটা যাতে সহিংসতার দিকে না যায়, সে ব্যাপারে এলাকার মুরব্বি ও অভিভাবকদের দায়িত্ব নিতে হবে। কিশোর-তরুণদের গঠনমূলক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে যুক্ত করতে হবে।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ