সাংবিধানিক পরিষদ গঠনে ড. কামালের রূপরেখা
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন প্রশ্নে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের পাশাপাশি দেশে একটি ‘সাংবিধানিক পরিষদ’ গঠনের প্রাথমিক রূপরেখাও তুলে ধরেছেন। জানা গেছে, এর লক্ষ্য হলো এবারের নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের পরে ভবিষ্যতে কোনো এক সময়ে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানে স্থায়ীভাবে পরিষদব্যবস্থা সংযোজন করা। এই পরিষদ শুধু নির্বাচন কমিশনই নয়, সব ধরনের সাংবিধানিক সংস্থা সদস্যদের নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেবে।
ড. কামাল হোসেন বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ছিলেন। বাহাত্তরের সংবিধানে সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর নিয়োগে কোনো সমন্বিত বিধান ছিল না। কিন্তু নির্বাচন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠনে নির্দিষ্টভাবে আইন করার নির্দেশনা ছিল। অথচ তার কোনোটিই করা হয়নি। ২০১৭ সালে এসে আওয়ামী লীগ প্রথমবারের মতো ১১ জানুয়ারিতে বলেছে, নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন করা হোক। কিন্তু তাও এবারে হবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। সে কারণে ড. কামাল হোসেনের তরফে যে প্রস্তাবটি এসেছে, তা সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত। কারণ, প্রতিটি সাংবিধানিক সংস্থার জন্য আলাদা আইন করার দরকার নেই। বিশ্বের অন্তত ১৯টি দেশে সরাসরি সাংবিধানিক পরিষদ নামেই সংস্থা রয়েছে। সুতরাং ড. কামাল হোসেন নতুন বছরে জাতিকে নতুন আশার বাণী শুনিয়েছেন। আমরা প্রাথমিকভাবে আশ্বস্ত হতে পারি যে সংবিধান বিষয়ে যাঁরা সবচেয়ে সেরা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিবেচিত, তাঁদেরই একজনের কাছ থেকে আমরা সাংবিধানিক পরিষদের রূপরেখা পেলাম। এটা আসলে একটি সাংবিধানিক সংস্কারের প্রস্তাব।
৮ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের শেষ পর্যায়ে ড. কামাল হোসেন সাংবিধানিক পরিষদ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বলে জানা গেছে। এ সময় তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে নেপাল ও শ্রীলঙ্কার সাংবিধানিক পরিষদ গঠনের বিধানাবলির অনুলিপি হস্তান্তর করেন। এই দুটি দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়াকে অন্যান্য সাংবিধানিক সংস্থার গঠনপ্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা হয় না।
১৯৫৮ সালে প্রবর্তিত ফ্রান্সের সাংবিধানিক পরিষদকে নির্বাহী বিভাগের একচেটিয়া ক্ষমতার অনুশীলনের বিরুদ্ধে একটি উত্তম রক্ষাকবচ হিসেবে দেখা হয়। নেপাল ও শ্রীলঙ্কাও একই উদ্দেশ্য সাধনে পরিষদ তৈরি করেছে। ফ্রান্সের সাংবিধানিক পরিষদ নির্বাচনকালে নির্বাচনী আইনসংক্রান্ত জটিলতা তাৎক্ষণিক নিরসনে সর্বোচ্চ আদালতের মতো ভূমিকা পালন করে থাকে।
নেপালের নতুন সংবিধানের ২৮৪ অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রধান বিচারপতি এবং সাংবিধানিক সংস্থাসমূহের প্রধান ও কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেবে সাংবিধানিক পরিষদ। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন এই পরিষদের সদস্যরা হলেন প্রধান বিচারপতি, সংসদের নিম্নকক্ষের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও বিরোধী দলের নেতা এবং উচ্চকক্ষের চেয়ারপারসন। কোনো সাংবিধানিক পদ শূন্য হওয়ার এক মাস আগে সাংবিধানিক পরিষদ তার সুপারিশ প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠায়।
শ্রীলঙ্কার সংবিধানের ৪১(ক) অনুচ্ছেদে সংবিধানিক পরিষদ গঠনের বিধান আছে। স্পিকারের নেতৃত্বাধীন এ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও প্রেসিডেন্ট-মনোনীত সংসদ সদস্য আছেন। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার মধ্যে একটা সদ্ভাব বজায় রাখারও চেষ্টা করেছে শ্রীলঙ্কা।
তাঁরা উভয়ে পাঁচজনকে মনোনয়ন দেবেন। এর মধ্যে দুই সাংসদ ও তিনজন বিশিষ্ট নাগরিক থাকবেন। এ ছাড়া সরকারি ও প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রাধান্য খর্ব করারও চেষ্টা আছে। সে কারণে বলা আছে, দুই প্রধান দল ব্যতিরেকে সংসদের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকে একজনের বিষয়ে সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠের বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট একজনকে মনোনয়ন দেবেন।
প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতা যাতে নিজ নিজ দলের সদস্যদের মনোনয়ন না দেন, সে জন্য বলা হয়েছে, তাঁরা সদস্য বাছাই করতে গিয়ে সংসদের প্রতিনিধিত্বকারী অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র গ্রুপের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। বাছাই করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতা নিশ্চিত করবেন যে সাংবিধানিক পরিষদটি সামাজিক ও পেশাগত বৈচিত্র্যসংবলিত বহুপক্ষীয় চরিত্র ধারণ করেছে। বিশিষ্ট নাগরিকেরা হবেন নির্দলীয়।
প্রেসিডেন্টের কাছে নাম প্রেরণের ১৪ দিনের মধ্যে নিয়োগ চূড়ান্ত করবেন। কিন্তু তিনি তাতে ব্যর্থ হলে মনোনীতরা আপনা-আপনি নিয়োগ পেয়েছেন বলে গণ্য হবে।
শ্রীলঙ্কার সাংবিধানিক পরিষদ নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, পুলিশ কমিশনসহ নয় ধরনের কমিশন গঠনে ভূমিকা পালন করে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়োগে সাংবিধানিক পরিষদকে প্রধান বিচারপতির মতামত নিতে হয়।
উল্লেখ্য, ২০০১ সালে ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি সংবিধানের ১৭তম সংশোধনীর মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এ বিধান যুক্ত করে। প্রেসিডেন্টের হাতে থাকা নিরঙ্কুশ নির্বাহী ক্ষমতার প্রয়োগ অধিকতর গণতন্ত্রসম্মত করতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। ২০১০ সালে প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে এ বিধান বিলোপ করলেও ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা ১৯তম সংশোধনীর মাধ্যমে তা ফিরিয়ে আনেন।
ড. কামাল হোসেন রাষ্ট্রপতিকে ১৯৯৩ সালে বর্ণবাদ অবসান-পরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা প্রবর্তিত স্বাধীন মিডিয়া কমিশন আইনের একটি কপিও হস্তান্তর করেন। এ মিডিয়া কমিশনের দায়িত্ব হলো নির্বাচনকালে সব রাজনৈতিক দলের জন্য গণমাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণার সমতা রক্ষা করা। ড. কামাল হোসেন ১৯৯৩ সালে কমনওয়েলথ পর্যবেক্ষণকারী দলের সদস্য হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন।
এর আগে রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বাধীন ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশন গঠনের আলোচনায় অংশ নেয়। এই দলের জ্যেষ্ঠ নেতা ও সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘আমরাও সাংবিধানিক পরিষদ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছি। তবে তা শুধু নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্যই। আমরা আশা করব, প্রস্তাবিত সাংবিধানিক পরিষদ নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ফলপ্রসূ ও অর্থপূর্ণ আলোচনায় যোগ দেবে।’