তারেক সাঈদের বিরুদ্ধে গুমের বহু অভিযোগ

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: শুধু নারায়ণগঞ্জের সাত খুন নয়, র‍্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদের বিরুদ্ধে গুম-খুন-অপহরণের কমপক্ষে এক ডজন অভিযোগ পাওয়া গেছে। শীতলক্ষ্যা নদী থেকে যেমন পেট চেরা সাতটি লাশ উদ্ধার করা হয়, তেমনি মেঘনা নদী থেকেও অপহৃত এক ব্যবসায়ীর লাশ উদ্ধার করা হয়। তদন্তে তারেক সাঈদের অধীন র‍্যাব-১১-এর সঙ্গে এ ঘটনার সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে। আবার কোনো কোনো মামলায় সরাসরি তাঁকে আসামি করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো চায়, তারেককে জিজ্ঞাসাবাদ করে এসব ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হোক।
র‍্যাব-১১-এর আওতায় থাকা নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, মুন্সিগঞ্জ, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, নরসিংদী ও ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ ও দোহার এলাকায় বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সব ঘটনায় মামলা হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলা হলেও তদন্তে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে বলা হয়েছে, কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মামলার রায়ে তারেক সাঈদ মোহাম্মদের মৃত্যুদণ্ড হওয়ায় ওই সব ঘটনার শিকার পরিবারগুলো এখন আশা করছে, তাদের মামলাগুলো সচল হবে। মন্ত্রীর জামাতা হিসেবে তিনি বিশেষ কোনো সুবিধা পাবেন না।

লাকসাম থেকে অ্যাম্বুলেন্সে কুমিল্লা আসার পথে ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর অপহৃত হন উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সাংসদ সাইফুল ইসলাম হিরু এবং পৌর বিএনপির সভাপতি হুমায়ূন কবীর পারভেজ। ওই ঘটনায় অপহৃত ব্যক্তিদের স্বজনেরা আদালতে তারেক সাঈদ মোহাম্মদকে এক নম্বর আসামি করে মামলা করেন।

ওই ঘটনায় বাদীপক্ষের আইনজীবী বদিউল আলম বলেন, ওই রাতে র‍্যাব-১১-এর একটি দল অ্যাম্বুলেন্সের পথ রোধ করে প্রথমে সাইফুল ইসলাম হিরু, হুমায়ূন কবীর পারভেজসহ চারজনকেই তুলে নেয়। পরে বাকি দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। লাকসাম পুলিশ র‍্যাবের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা নিতে চায়নি। একটা নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়েছিল। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে কুমিল্লা আদালতে মামলা করা হয়। আদালতের নির্দেশে পুলিশ তদন্ত করে এবং চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে জানায়, তারা র‍্যাবের কোনো সম্পৃক্ততা পায়নি। পরিবারের পক্ষ থেকে আদালতে না-রাজি দেওয়ায় মামলাটি সিআইডিকে দেওয়া হয়। সিআইডিও দায়িত্ব পেয়েছে দেড় বছর আগে। সিআইডি কেন কিছু বলছে না জানতে চেয়ে আদালতের মাধ্যমে সিআইডিকে একটি তলব পাঠানো হয়। তিন ভাগে সিআইডি আদালতকে জবাব পাঠায়। সিআইডি বলে, তারা আসামিদের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি পায়নি। সিআইডি আরও জানায়, অপহরণের পর পরিবার থানায় যে জিডি করে, পুলিশ সেই জিডির তদন্ত প্রতিবেদন দেয়নি। আগের তদন্তকারী কর্মকর্তা সাক্ষীদের যে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন, সেই কাগজপত্র তারা পায়নি। সে কারণে তাদের দেরি হচ্ছে।

সাইফুল ইসলাম হিরুর ছেলে রাফসান ইসলাম গতকাল মঙ্গলবার বলেন, ‘আমরা বিচার চাই। আমরা যাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি, তাদের কাছ থেকে জানতে চাওয়া হোক আমার বাবা কোথায় গেছে। অন্তত একটা খবর চাই আমরা। তিন বছর ধরে আমরা শুধু আমাদের বাবার একটা খবর চাই।’ হুমায়ূন কবীর পারভেজের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার আঁখি বলেন, ‘তারেক সাঈদকে জিজ্ঞেস করলেই সবকিছু জানা যাবে। সে সব জানে।’

লক্ষ্মীপুরে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাহাব উদ্দিন সাবুর বাসা র‍্যাব-১১-এর একটি দল ঘেরাও করে বলে অভিযোগ করা হয়েছে একটি মামলার এজাহারে। ওই দিন বাসার সামনে রাখা তাদের দুটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘সাহাব উদ্দিন সাবুর বাসা ঘেরাও করা হয়েছে শুনে আমার স্বামী ইকবাল মাহমুদ জুয়েল বাসা থেকে বের হয়। ১৫-২০ মিনিট পর সদর হাসপাতাল রোডের বাসায় বসে আমি তিনটা গুলির শব্দ পাই। কিছুক্ষণ পরই খবর আসে জুয়েল জায়গাতেই মারা গেছে। লাশটা পর্যন্ত দেয়নি।’ তিনি বলেন, কোনো অবস্থায় যেন তারেক সাঈদ ছাড়া না পান, সে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। আদালত একটি ঘটনায় রায় দিয়েছেন। রায় কার্যকর হলে তাঁরা স্বস্তি পাবেন।

ওই একই সময়ে জামায়াতের আমির ফয়েজ আহম্মেদকে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে র‍্যাব-১১-এর বিরুদ্ধে। গুম-সংক্রান্ত সম্মেলনে পরিবারের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে এই অভিযোগ করা হয়। তবে এখন আর তাঁরা কোনো কথা বলতে চান না।

অপহরণের ১৩ দিন পর মেঘনা নদীতে ভেসে ওঠে পেট চেরা একটি লাশ। এটি ব্যবসায়ী তাজুল ইসলামের বলে শনাক্ত করেন তাঁর বাবা। ২০১৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সোনারগাঁয়ের রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় তাজুলকে একটি হাইয়েস গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই ঘটনায় সোনারগাঁ থানায় একটি মামলা হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে গুমবিরোধী একাধিক মানববন্ধনে অভিযোগ করা হয়েছে, ওই হাইয়েস গাড়িতে করে র‍্যাব-১১-এর সদস্যরাই তাজুলকে অপহরণ করে নিয়ে গেছেন। মামলার তদন্তে যুক্ত একজন কর্মকর্তা বলেন, তাজুল অপহৃত হন একটি বিরোধকে কেন্দ্র করে। সেই বিরোধে র‍্যাব-১১-এর সম্পৃক্ততা ছিল। কিন্তু গুমের ঘটনা প্রমাণে যে তথ্যপ্রমাণ দরকার, তা পুলিশ জোগাড় করতে পারেনি। পরে পুলিশ তদন্ত শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়।

বালু ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেনকে অপহরণ করা হয় ২০১৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কাঁচপুর ব্রিজ এলাকা থেকে। তিনি এখনো নিখোঁজ। তাঁর পরিবার এই বিষয়টি নিয়ে কয়েকবার র‍্যাব-১১-তে গেছে। সাত খুনের ঘটনার পর ২০১৫ সালের ১৯ নভেম্বর তারেক সাঈদসহ আরও ২৪ জনের নামে ইসমাইলের স্বজনেরা অভিযোগ দাখিল করেন। স্বজনেরা এখন বলছেন, নূর হোসেন তারেক সাঈদ মোহাম্মদের সহযোগিতায় ওই ঘটনা ঘটিয়েছেন।

বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, একটি বিচারিক প্রক্রিয়ায় তারেক সাঈদ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের হোতা হিসেবে প্রমাণিত হয়েছেন। এটা থেকে এ ধারণা করার যৌক্তিক যে এ ধরনের অন্যান্য অপরাধেও তিিন জড়িত থাকতে পারেন। তাই তার বিরুদ্ধে আনা সব মামলার সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য তদন্ত হতেই হবে।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘মামলা হলে আইনের নিজস্ব গতিতে মামলা চলবে। তবে অনেক সময় অনেক অভিযোগ আসে, যেগুলো ভিত্তিহীন ও মনগড়া।’

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ