দুদকের কাজে চমক নয় নজির চাই

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ২০১৭ সালে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান আরও তীব্র হবে। ফাঁদ পেতে দুর্নীতিবাজদের ধরার কার্যক্রমও হবে জোরদার। ইদানীং বেশ কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থা প্রশংসিত হয়েছে বিভিন্ন মহলে। আবার এর বিরূপ সমালোচনাকারী একটি মহলও রয়েছে সক্রিয়। সাধারণভাবে ধরে নেওয়া যায়, এ ধরনের অভিযান বা কার্যক্রমে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হন বা হতে পারেন, তাঁদের এর প্রশংসা করার কথা নয়। তাঁরা সমালোচনা এবং সময় ও সুযোগ বুঝে এর বিরুদ্ধে অবস্থানও নিতে পারেন। তবে দেশের বিবেকবান মানুষের সঙ্গে দুর্নীতির সম্পর্ক নেই। বরং চলমান দুর্নীতি তাঁদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে পড়েছে। তাই তাঁরা দুদকের এ কার্যক্রমের প্রশংসা করবেন ও সমর্থন জানাবেন, এটাই স্বাভাবিক। চাইবেন এ ধরনের অভিযান জোরদার হোক। আঘাত করতে সক্ষম হোক দুর্নীতির ঘাঁটিতে।
২০০০ সাল থেকে পরপর কয়েকবার বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের কুখ্যাতি আমরা অর্জন করেছিলাম। এরই পটভূমিকায় সুশীল সমাজ একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন দাবি জানাতে থাকে। উন্নয়ন–সহযোগী রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলোও এ বিষয়ে অনুকূল অবস্থান নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৪ সালে একটি আইনের মাধ্যমে গঠিত হয় স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন। কিন্তু এর নেতৃত্বে যাঁদের নেওয়া হয়, তাঁরা সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারেননি। সে পরিপ্রেক্ষিতে এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর নতুন নেতৃত্ব আসে। সে সময় আবার সংস্থাটির বিরুদ্ধে অতিমাত্রায় সক্রিয়তার অভিযোগ আসতে থাকে। ২০০৯ সালে সংস্থায় কিছুটা পরিবর্তনের পর এটা অনেকটা স্থবির হয়ে যায়। সে স্থবিরতাও চলে লম্বা সময়। মাত্র বছরখানেক আগে আবারও আসে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের নেওয়া পদক্ষেপগুলো নতুন আশার সঞ্চার করে সমাজজীবনে। অবশ্য এখন পর্যন্ত তাদের কার্যক্রমের পরিসর প্রান্তিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকছে। রুই-কাতলারা থেকে যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বরং তারা চলছে বুক ফুলিয়ে। এ থেকে ধরে নিতে হবে গোটা সমাজ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে অবস্থান না নিলে শুধু গুটিকয়েক লোক বা একটি সংস্থার মাধ্যমে ব্যাপক কোনো ভূমিকা রাখা সম্ভব নয়। আর সমাজকে এ বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ করতে প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। বর্তমান ক্ষমতাসীন জোট সমাজজীবন থেকে দুর্নীতি উৎপাটনে অঙ্গীকারবদ্ধ। হয়তোবা এ অঙ্গীকারের ধারাবাহিকতায় আমরা কমিশনকে সাম্প্রতিক কালে কিছুটা কার্যকর দেখতে পারছি। আবার আশঙ্কা হচ্ছে, সীমাবদ্ধতা আছে তাদের অনেক। এটা কাটিয়ে ওঠা খুব সহজ কাজ, এমন দাবি করা যাবে না। তবে প্রায় জরাগ্রস্ত একটি প্রতিষ্ঠানকে কিছুটা সচল করতে পারারও প্রশংসা করতে হবে।
তাদের কার্যক্রমের একটি হচ্ছে ঘুষ লেনদেনকালে আসামিকে ধরে ফেলা। এ রকম বেশ কিছু কাজ তারা সফলভাবে করতে পেরেছে। এর আওতায় এখন পর্যন্ত সরকারের মধ্য পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও আনা গেছে। এ কার্যক্রমের কিছু হলেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সতর্ক হবেন কেউ কেউ। আর চলমান কার্যক্রম জোরদার ও ফলপ্রসূ হলে ঘুষ-বাণিজ্যে কিছুটা ভাটা পড়বে, এমনটা আশা করাও অমূলক নয়। তবে একে ফলপ্রসূ করতে হলে কিছু বিষয়ের প্রতি নজর দেওয়া আবশ্যক। আইনত ঘুষ গ্রহণ, টাকার পরিমাণ-নির্বিশেষে শাস্তিযোগ্য। আর শাস্তির মাত্রারও হেরফের তেমন নেই। তা সত্ত্বেও এসব ক্ষেত্রে নজর রাখা দরকার বেশি টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রগুলোতে। চুনোপুঁটি আর রুই-কাতলার প্রসঙ্গ প্রায়ই আনা হয়। চুনোপুঁটিদের ছেড়ে দেওয়ার কথা কেউ বলছে না। তবে মূল নজর রাখুন রুই-কাতলাদের দিকে। হঠাৎ হঠাৎ দু-চারটি রুই-কাতলা কিন্তু ধরতে হবে। নচেৎ বিষয়টা একপর্যায়ে মামুলি একটি প্রথা হিসেবে জনমনে গণ্য হবে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান কার্যকর, ফলপ্রসূ ও টেকসই অবদান রাখতে পারবে না। বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায়ও আমরা এ দাবি থেকে সরতে পারি না। হয়তো আরও ধৈর্য ধরতে হবে। তবে দুর্নীতিমূলক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে যথার্থ আঘাত করছে, এটা কিন্তু আমরা দেখতে চাই।
তবে এ ধরনের আঘাত করতে হলে রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্য সংস্থাগুলোরও দুদককে নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন দিয়ে যেতে হবে। তাদের উপযুক্ত জনবলকাঠামো তৈরি, প্রশিক্ষণসহ সব কাজে উদারভাবে অর্থ ব্যয় আবশ্যক। দেশি-বিদেশি সব অর্থনীতিবিদই মনে করেন, আমাদের দেশে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রিত হলে জিডিপি প্রায় ২ শতাংশ বেড়ে যাবে। এ অবস্থায় দুদকের সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ প্রাসঙ্গিক কাজে অনুদার হওয়া অসামঞ্জস্যপূর্ণ। অভিযান পরিচালনা করার জন্য উপযুক্ত জনবল যে নামেই হোক, দুদকের অভ্যন্তরে তৈরি করতে হবে। তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামাদির জোগান না দিলে চলবে না। তবে কমিশন নেতৃত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের মনে রাখা দরকার, এ সংস্থার অভ্যন্তরে দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতোই দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা রয়েছেন। তাঁদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনাও দুদকেরই কাজ। দুদক কার্যক্রমের তীব্রতা যত বৃদ্ধি পায়, তাঁদের ঘুষ-বাণিজ্য ততোধিক বাড়ে বলে ব্যাপক জনশ্রুতি রয়েছে। আর এটা অস্বাভাবিকও নয়। ওপরের স্তর যতই পরিচ্ছন্ন ও কঠোর হোক, দুদকের পূর্বসূরি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন ব্যুরোর সময়কার ধারাবাহিকতা থেকে তারা তেমন একটা মুক্ত হতে পারেনি।
প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিদের কিছু অপরাধ তৃতীয় পক্ষ কর্তৃক দেখাই যুক্তিসংগত। তবে এ পর্যায়ে দুদকের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার ওপর অন্য কোনো সংস্থা চাপিয়ে দিলে ক্ষমতার অপব্যবহার হতে পারে ব্যাপক। ব্যাহত হতে পারে স্বাধীন তদন্ত কার্যক্রম। তাই কমিশনকেই তাদের অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি অভিযানকে অবিরাম চলমান রাখতে হবে। অন্য প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যেমন ফাঁদ পাতা হচ্ছে, তেমনি দুদকের কর্মরত অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তাদের দিয়ে মাঝেমধ্যে কোনো দুদক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তা পাতা যায়। এর জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে কিছু পরিবর্তন কর্মকর্তার একটি টিম দুদক নেতৃত্বের আওতায় থাকতে পারে। কোনো দুদক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কমিশন দুর্নীতির অভিযোগ পেতে থাকলে সক্রিয় করতে পারে সে টিমটিকে। সে সংস্থার সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের বিবরণাদি খুঁটিয়ে দেখার জন্যও একটি সেল করা দরকার। যেখানে প্রযোজ্য ব্যাংক হিসাব তলব বা অন্যভাবে সম্পদের হিসাব নেওয়ার ব্যবস্থা করাও আবশ্যক। এত কথা বলার প্রয়োজন দুদককে শক্তিশালী করতেই। উঁচু নৈতিক মানসম্পন্ন পেশাদার ব্যক্তি ছাড়া দুদক মামলার অনুসন্ধান, তদন্ত, চার্জশিট প্রদান আর আদালতে মামলা পরিচালনা—কোনোটাই সঠিকভাবে হবে না। আমাদের জন্য এটা
আনন্দ ও স্বস্তির বিষয় যে দুদক চেয়ারম্যান নিজেই তাঁর সংস্থার অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি সম্পর্কে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর এ ভূমিকা বিরল ও প্রশংসনীয়।
সমাজ থেকে দুর্নীতির মূল উৎপাটন সহজ কাজ নয়। তবে উপযুক্ত নজরদারি আর দুর্নীতিলব্ধ অর্থ ব্যয়ের সুযোগ হ্রাস করে দিতে পারলে এটা নিয়ন্ত্রিত হবে। ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে। জ্ঞাত কোনো আয়-রোজগার নেই; অথচ বাড়ি-গাড়ির চমকে চোখ ঝলসে যায় এমন লোক তো আমরা হামেশাই দেখি। এরা বেআইনিভাবে পরধন নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে তা করছে। এটা ক্রমান্বয়ে হ্রাস করতে পারলেও কাজ হবে। আইনের বেড়াজালে এনে তাদের সে সম্পদ ভোগ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা প্রয়োজন। গুটিকয়েক করা শুরু হলেই অন্যরা সতর্ক হবে। হাত গোটাবে। আর এগুলো করার জন্যই ‘ওয়াচ-ডগ’ দুদক। তবে তাদের যাত্রাপথ দুর্গম। উল্লেখ্য, এ দেশে এ রকম অনেক দুঃসাধ্য কাজ সম্ভব হয়েছে। খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। ঘটেছে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার। অথচ একসময় এগুলোকে প্রায় অসাধ্য মনে হয়েছে। তবে দুদকের চ্যালেঞ্জ ভেতরে-বাইরে। তা সত্ত্বেও হাত গুটিয়ে থাকলে তো চলবে না। আর কম্পিত পদক্ষেপেও এ পথ পাড়ি দেওয়া যাবে না। সবল ও দৃঢ় হতে হবে পদক্ষেপ। তাদের ডাক না শুনে প্রথমে কেউ না এলেও একলাই চলতে হবে। পরে অবশ্য অনেকেই আসবে। কোনো হঠকারিতা নয়। বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতকে অবশ্যই বিবেচনায় নিয়ে যতটুকু সম্ভব এগোতে হবে। তাদের কিছু কার্যক্রম দৃশ্যমান হওয়া আবশ্যক। চমক নয়, নজির সৃষ্টির জন্য সে ধরনের তৎপরতা আমরা চাই। আর চাই দুদকের ক্রমবর্ধমান সাফল্য।

আলী ইমাম মজুমদার

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ