নূর হোসেনের রায়ের পর যে চ্যালেঞ্জ
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: দুই বছর সাত মাস আগে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা যেমন দেশব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল, এই মামলার রায়ও তেমনি আলোড়ন তুলেছে। গত সোমবার জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন যখন রায়টি ঘোষণা করেন, তখন পুরো আদালতকক্ষ ছিল জনাকীর্ণ। ৪ মিনিটের সংক্ষিপ্ত রায়ে বিচারক অভিযুক্ত ৩৫ আসামির সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করেন, যাঁদের মধ্যে ২৬ জন পেয়েছেন সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং বাকি ৯ জন বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত হয়েছেন। পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ কিংবা ১৯৭৭ সালের সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ ছাড়া আর কোনো মামলায় এত বিপুলসংখ্যক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড পাননি।
এই রায় অনেকগুলো সত্য আমাদের সামনে হাজির করেছে। প্রথমত, অপরাধীরা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, তাদের শাস্তি পেতে হবে। সেদিক থেকে এই রায় প্রতিটি শান্তিকামী মানুষের জন্য স্বস্তিদায়ক। কিন্তু কঠিন চ্যালেঞ্জ হলো যে রাজনীতি ও সমাজ নূর হোসেনদের তৈরি করে, সেই সমাজ ও রাজনীতির শুদ্ধিকরণ। পাকিস্তান আমলে আমরা পাঁচপাত্তুরদের দৌরাত্ম্য দেখেছি। স্বাধীনতার পর প্রধানেরা হয়ে উঠেছিল দুর্ধর্ষ। এরপর ইমদু-অভি আমল পার হয়ে এখন নূর হোসেনদের জমানা চলছে। এই ছোট নূর হোসেনদের পেছনে যে বড় নূর হোসেনেরা আছেন, তাঁদের নিবৃত্ত করতে না পারলে কেবল খুনের বিচার করে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করা যাবে না।
দ্বিতীয় সত্যটি হলো র্যাবের যে ১৬ জন সদস্যের মৃত্যুদণ্ড হলো, যাঁদের মধ্যে র্যাবের পদচ্যুত তিন কর্মকর্তা যথাক্রমে তারেক সাঈদ, এম এম রানা ও আরিফ হোসেনও আছেন। নারায়ণগঞ্জে তাঁদের দায়িত্ব ছিল অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, পুলিশকে সহায়তা করা। কিন্তু ঘটনাক্রমে তাঁরা অপরাধীদের হয়ে কাজ করলেন। সাত খুনের ঘটনা ঘটালেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ব্যক্তির অপরাধের দায় বাহিনী নেবে না। বিচারের মাধ্যমে যাঁরা দুষ্কর্ম করেছেন, এই রায়ের মাধ্যমে তাঁদের জন্য সতর্কবার্তা যাবে। ব্যক্তির দুষ্কর্মের দায় বাহিনীর নয় সত্য। কিন্তু যখন বাহিনীর নাম ব্যবহার করে এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ ঘটানো হলো, তখন বাহিনী নৈতিক দায় এড়াবে কীভাবে? বিচারের বিষয়টি ঘটে অপরাধ সংঘটনের পর। ফলে এ ধরনের অপরাধ যেন কোনো বাহিনীর সদস্যরা করতে না পারেন, সেটা নিশ্চিত করাই আসল কথা। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে কেউ ওই বাহিনীর নাম ব্যবহার করে অপরাধ করতে না পারেন। সাধারণ মানুষের অপরাধের সঙ্গে বাহিনীর কোনো সদস্যের অপরাধকে মেলানো যাবে না এ কারণে যে, অপরাধ নিবৃত্ত করার জন্যই তাঁকে রাষ্ট্র নিয়োগ করেছে।
অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনার মূলে ছিল রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। বাসের হেলপার থেকে নূর হোসেনের দুর্ধর্ষ অপরাধী ও গডফাদারে পরিণত হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক আশ্রয় ও প্রশ্রয় ছিল। যখন যে দল ক্ষমতায় ছিল বা আছে, সেই দলে যোগ দিয়ে তিনি দুষ্কর্ম করেছেন। ব্যক্তি নূর হোসেনের বিচার হলেও যে অসুস্থ রাজনীতি নূর হোসেনদের তৈরি করেছে, সেই রাজনীতির অবসান ঘটাতে না পারলে গুম-খুনের রাজনীতি বন্ধ করা যাবে না। সরকার কীভাবে একজন ব্যক্তির নিরাপত্তায় ১০-১২টি আগ্নেয়াস্ত্রের ছাত্রপত্র দিল? এই ছাত্রপত্র নেওয়ার মাধ্যমেই তিনি নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে ভাবতে থাকেন।
২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল আদালত থেকে বাড়ি ফেরার পথে অপহরণ করা হয় নজরুল ইসলামকে এবং তা দেখে ফেলায় আইনজীবী চন্দন সরকারসহ আরও ছয়জন অপহরণের শিকার হন। এরপর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে ছয়টি এবং পরে আরও একটি লাশ ভেসে ওঠে। মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, নজরুল ইসলামসহ অপহৃত সাতজনকে হত্যা করে নদীতে ইটচাপা দিয়েছিল ঘাতকেরা। এই হত্যার মূল পরিকল্পকারী নূর হোসেন কলকাতায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও শেষ রক্ষা হয়নি। সরকার তাঁকে ফিরিয়ে এনে বিচার করেছে। ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে যেসব খবর বের হয়েছে, তাতে দেখা যায়, মাদক ব্যবসা থেকে চাঁদাবাজি-সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় এমন কোনো অপরাধ নেই যা নূর হোসেন করেননি। তাঁর এসব অপকর্ম ধামাচাপা দিতে নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং রাজনৈতিক দলের গুরুদের চাঁদা দিতেন। তাঁর নির্মিত জলসা ঘরে দেশের হোমরাচোমরা ব্যক্তিরাও যেতেন।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বক্তৃতা বিবৃতিতে প্রায়ই ‘খামোশ’ শব্দ ব্যবহার করতেন। খামোশ মানে চুপ হওয়া। স্তব্ধ হওয়া। তিনি যেকোনো অন্যায়কারীকে হুঁশিয়ার করে দিতে বলতেন ‘খামোশ।’ সেই অন্যায় ও অপকর্মের মূর্ত প্রতীক একজন নূর হোসেন মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে কারাগারে থাকলেও তাঁর সহযোগীরা বহাল তবিয়তে আছেন। তাঁর অবৈধ সাম্রাজ্য পাহারা দিচ্ছেন।
সাত খুনের বিচারের পর যে অপরাজনীতি নূর হোসেনদের তৈরি করে, সেই রাজনীতি খামোশ করতে সরকার কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেবে কি? না নিলে নতুন নতুন নূর হোসেন ও তাঁর নতুন নতুন আশ্রয়দাতারা জন্ম নেবেন।
লেখক: সোহরাব হাসান