২২৬ কোটি টাকার সারের হদিস নেই
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থার (বিসিআইসি) গুদামে কাগজে-কলমে যে সার থাকার কথা, বাস্তবে তা নেই। সরকারের বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর সম্প্রতি এক নিরীক্ষায় ৮৬ হাজার ৬৫৭ মেট্রিক টন সারের কোনো হদিস পায়নি। ওই সারের বাজারমূল্য ২২৬ কোটি টাকা।
বিসিআইসির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রভাবশালী একটি চক্র কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশে প্রতিবছর সার পরিবহন ও গুদামে পৌঁছে দেওয়ার নামে কোটি কোটি টাকার সার বাইরে বিক্রি করে দেয়। আর ২১ দিনে সার পরিবহন করার কথা থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো সেই সময়ে পৌঁছায় না। ফলে সারের বস্তা খারাপ হয়ে যায়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, বিসিআইসির বাফার গুদামগুলো জায়গা নেই বলে সময়মতো সার নেয় না। এ কারণেই এ সমস্যা হয়। তবে দুই পক্ষের যোগসাজশেই সার নিয়ে অনিয়ম হয় বলে অভিযোগ। এ নিয়ে যথাযথ তদন্ত হচ্ছে না। এমনকি বিভিন্ন সময়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অনেককে চিহ্নিত করা হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বিসিআইসির চেয়ারম্যানের যোগসাজশেই এসব হয় বলে অভিযোগ।
বিষয়টি জানতে চাইলে বিসিআইসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, ‘সার পরিবহনের নামে নানা ধরনের অনিয়ম ঘটে। আমি দুই বছর ধরে এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি। ২১ দিন থেকে আমরা সার পরিবহনের সময় পাঁচ দিনে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছি, যাতে এসব অনিয়ম বন্ধ হয়।’
বিসিআইসি গত অর্থবছরে ১৭ লাখ ১৭ হাজার ৩৬৯ মেট্রিক টন সার আমদানি করে, যার দাম ৪ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা। বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত বিসিআইসির ২০১৫-১৬ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষা হয়। এরপর ২৪ অক্টোবর বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর থেকে বিসিআইসির চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, শিল্প মন্ত্রণালয় যে হিসাব দিয়েছে, তাতে দেখা গেছে যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের কাফকো সার কারখানা এবং বিদেশ থেকে আমদানি করা ৩ লাখ ৮১ হাজার ৮৯৭ মেট্রিক টন ইউরিয়া সার বিভিন্ন গুদামের জন্য পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বিসিআইসির নথিতে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন গুদামে ২ লাখ ৯৫ হাজার ২৩৯ মেট্রিক টন সার পৌঁছেছে। অর্থাৎ, ৮৬ হাজার ৬৫৭ মেট্রিক টন সারের কোনো হদিস নেই। এই সারের বাজারমূল্য ২২৬ কোটি ৬০ লাখ ৯৯ হাজার ৩৩৭ টাকা।
এই বিপুল পরিমাণ সারের গরমিল ও রাষ্ট্রীয় ক্ষতির কারণ জানতে গত ২৪ অক্টোবর বাণিজ্যিক অধিদপ্তর থেকে বিসিআইসির চেয়ারম্যানের কাছে জবাব চাওয়া হয়। তবে বিসিআইসি এ বিষয়ে এখনো অডিট অধিদপ্তরকে কোনো জবাবই দেয়নি। এ ঘটনায় একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তারা এখনো কোনো প্রতিবেদন তৈরি করেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ ইকবাল বলেন, ‘বাণিজ্যিক নিরীক্ষায় যে তথ্য উঠে এসেছে, সে বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। তারা চাইলে ফৌজদারি মামলা দায়েরের সুপারিশ করতে পারে।’ ওই নিরীক্ষা যিনি করেছেন, সেই কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই তাঁরা প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।
বিসিআইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিরীক্ষা অধিদপ্তর ৮৬ হাজার মেট্রিক টন সারের অনিয়ম পেলেও বাস্তব অবস্থা আরও খারাপ। এখন বিসিআইসির অধীন সার কারখানাগুলো বন্ধ রেখে বিদেশ থেকে সার আনা হচ্ছে। কারণ, যত বেশি সার আমদানি হয়, ততই দুর্নীতির সুযোগ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শুরুতে ১৩ লাখ ৫০ হাজার ৭৫০ মেট্রিক মেট্রিক টন ইউরিয়া সার আমদানির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হলেও এর বাইরে আরও ৪ লাখ ১৬ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন সার হঠাৎ করেই চীন থেকে আনা হয়, যে সারের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। এই সারের অনেকগুলোই জমাট বেঁধে যায়। এ ছাড়া আমদানি করা সার বাফার গুদামে পৌঁছানোর নামে একটি চক্র অনেক দিন ধরেই বাণিজ্য করছে। ফলে বরাবরই অন্তত ২ লাখ মেট্রিক টন সারের হিসাবে গরমিল থাকে।
পথেই রয়ে গেছে যে সার
কার্যাদেশ পাওয়ার ২১ দিনের মধ্যে সার পৌঁছানোর কথা থাকলেও অনেক সার কখনোই পৌঁছায় না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাল্ক ট্রেডের বিরুদ্ধে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অভিযোগ। বিসিআইসি সূত্রে জানা গেছে, এই প্রতিষ্ঠানকে ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে মোট ৬ লাখ ৫২ হাজার মেট্রিক টন সার পরিবহনের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ৪ লাখ ২৬ হাজার ৭৭৫ মেট্রিক টন সার গুদামে পৌঁছেছে। বাকি ২ লাখ ১৪ হাজার ৭১৪ মেট্রিক টন সার পথে আছে বলে উল্লেখ করা হয়। ওই সারের দাম প্রায় ৭০০ কোটি টাকা।
বিসিআইসির কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, এভাবে ট্রানজিট বা পথে আছে উল্লেখ করা শত শত কোটি টাকার সারের হিসাব মেলে না। কারণ, সব সময়ই ঘুরেফিরে কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ পায়। তারা সব সময়ই সার পথে আছে বলে উল্লেখ করে।
বিষয়টি জানতে চাইলে বাল্ক ট্রেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুর রশীদ খানও বৈঠকের কথা বলে এড়িয়ে যান। প্রতিষ্ঠানটির কার্যনির্বাহী (বাণিজ্যিক) আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত বছরের ৩১ জুলাই আমরা বিসিআইসিকে যখন হিসাব দিয়েছিলাম, তখন ২ লাখ ১৪ হাজার মেট্রিক টন সার পৌঁছানো বাকি ছিল। এর মধ্যে সোয়া লাখ টান সার আমরা পৌঁছে দিয়েছি। ২৫ হাজার মেট্রিক টন এখনো পৌঁছাতে পারিনি। বাকি সার কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেগুলো পৌঁছানো হয়েছে, কিন্তু কাগজ বুঝে পাইনি।’ ২১ দিনে সার পৌঁছানোর কথা, সেটি হয় না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা বিসিআইসিকে বারবার চিঠি দিয়েছি। তারা বলে, গুদামে জায়গা নেই। আমরা কী করব?’
বাল্ক ট্রেডের বিরুদ্ধে সার পরিবহনে ৪ কোটি টাকার ভুয়া বিল দাখিলেরও অভিযোগ ওঠে। ৯ নভেম্বর বিসিআইসির এক নথিতে এই জালিয়াতি প্রমাণিত হওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শাহজালাল সার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে আইনি ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেয় বিসিআইসি। কিন্তু এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিষয়টি জানতে চাইলে আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাছে কাগজপত্র আছে।’
শতকোটি টাকার সার পাচার
বিসিআইসির কর্মকর্তারা বলছেন, কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিভিন্ন সময়ে সার পরিবহনের নামে শত শত কোটি টাকার সার বিক্রি করে দিলেও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নবাব অ্যান্ড কোম্পানির বিরুদ্ধে গত অর্থবছরে ১২টি গুদামে সার পরিবহনের সময় ২৮ হাজার ৩০৮ মেট্রিক টন সার পাচারের অভিযোগ ওঠে। ওই সারের বাজারমূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা। গত বছরের ১২ জুলাই ওই প্রতিষ্ঠানকে এ ব্যাপারে চিঠিও দেওয়া হয়। তাতে পাচার করা ওই সার দ্রুত নির্ধারিত বাফার গুদামে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। অন্যথায় দেওয়ানি ও ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়। বিসিআইসির কর্মকর্তারা বলছেন, এই চিঠির পর ২৮ হাজার ৩০৮ মেট্রিক টন সার পাওয়া গেলেও এই প্রতিষ্ঠান ২৫ থেকে ৩০ হাজার মেট্রিক টন সার লোপাট করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। অভিযোগ উঠেছে, আর্থিক লেনদেনের কারণেই ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে নবাব অ্যান্ড কোম্পানির কর্ণধার নবাব খান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনো কথা নেই। যা জানার বিসিআইসি থেকে জানেন।’
বিসিআইসির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও পথে সার আছে বলে হিসাব দেখানোর অভিযোগ অছে। গত বছরের ২১ এপ্রিল বিসিআইসির অতিরিক্ত প্রধান ব্যবস্থাপক নূর নবীর দেওয়া এক চিঠিতে বলা হয়, তিনি বিভিন্ন সময়ে ইউরিয়া সার পথে আছে (ট্রানজিট) বলে যে হিসাব দিয়েছেন, তাতে গরমিল আছে।
কেবল সার পাচার নয়, সার পরিবহনের নামে অতিরিক্ত টাকার বিল তুলে নেওয়ারও অভিযোগ আছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে সার নিয়ে বিভিন্ন গুদামের ইনচার্জ ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু চিঠি দিয়েই দায় সেরেছে বিসিআইসি। গত বছর আশুগঞ্জের মহেন্দ্রগঞ্জে বাফার গুদামের ইনচার্জ মোহাম্মদ হানিফ মিয়ার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ উঠলে বিসিআইসি থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তাতে বিসিআইসির বিপণন বিভাগের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) কাজী আনোয়ার হোসেনকে আহ্বায়ক এবং সহপ্রধান হিসাবরক্ষক আসাদুজ্জামান ও সহনিরীক্ষা কর্মকর্তা সাইরুল ইসলামকে সদস্য করার সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়। কিন্তু পরে যে তদন্ত কমিটি করা হয়, তাতে এই তিন কর্মকর্তার কাউকেই রাখা হয়নি।
আমদানি করা সার নিয়েও প্রশ্ন
গুদামে সার পৌঁছানোর ক্ষেত্রেই যে শুধু অনিয়ম ঘটে, তা নয়; সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশ থেকে যে সার আনা হচ্ছে, তাতে ওজনেও কম পাওয়া যাচ্ছে। গত অক্টোবর মাসে সৌদি আরব থেকে আমদানি করা প্রতি বস্তায় ৫০ কেজি করে ইউরিয়া সার থাকার কথা থাকলেও ৮ থেকে ১০ কেজি করে কম ছিল। বিসিআইসির রাজশাহীর বাফার গুদামে গত বছর ছেঁড়া-ফাটা বস্তায় জমাটবাঁধা ইউরিয়া সার পাওয়া যায়। সেখানেও অনেক বস্তায় কম সার ছিল।
দিনাজপুরেও আমদানি করা সারের মান খারাপ এবং ওজনে কম বলে অভিযোগ ওঠে। দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক গত বছরের ৩০ অক্টোবর বিসিআইসির চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে মজুত করা জমাটবাঁধা সার পুনরায় বস্তাবন্দী করার অনুরোধ করেন। কিন্তু জেলা প্রশাসকের ওই চিঠিও আমলে নেননি বিসিআইসির চেয়ারম্যান।
বিসিআইসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান চেয়ারম্যান যোগদানের পরপরই ব্যান্ডউইন নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ মেট্রিক টন সার ক্রয়ের জন্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ক্রয়াদেশ দেন। কিন্তু যথাসময়ে সার আনতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। নিয়ম অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে সার আনতে না পারায় প্রতিষ্ঠানটির ১৬ কোটি টাকার জামানত বাজেয়াপ্ত করার কথা। কিন্তু সেটি না করে অবৈধভাবে দুবার সময় বাড়ানো হয়। এরপর বিসিআইসির চেয়ারম্যান তৃতীয়বার ওই প্রতিষ্ঠানকে সময় বাড়ানোর প্রস্তাব দিলে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত কমিটি তা বাতিল করে দেয়।