ডিম পাড়তে সৈকতে আসার পথে মারা পড়ছে মা কচ্ছপ
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: গত মঙ্গলবার বেলা সাড়ে তিনটা। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সিগাল পয়েন্টে ভেসে আসে প্রায় ২০ কেজি ওজনের বিশাল একটি কচ্ছপ। কচ্ছপটির পেছনের বাঁ পা কাটা। মুখেও আঘাতের চিহ্ন। সম্ভবত ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয় কচ্ছপটির শরীর।
ভ্রমণে আসা পর্যটকদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ট্যুরিস্ট পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার রায়হান কাজেমি বলেন, জোয়ারের সময় মৃত কচ্ছপটি সৈকতে ভেসে আসে। কচ্ছপটির পেছনের বাঁ পা কাটা ছিল। এটি উদ্ধার করে পরিবেশ অধিদপ্তরে হস্তান্তর করা হয়েছে।
একই দিন সকালে সৈকতের নাজিরারটেক, ফদনারডেইল ও সমিতিপাড়া এলাকায় ভেসে আসে আরও অন্তত ১১টি মা–কচ্ছপের মৃতদেহ। মরা কচ্ছপগুলো নিয়ে টানাটানি করছিল কুকুরের দল। একাধিক কচ্ছপের পেটে ছিল ডিম।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম বলেন, গভীর সাগর থেকে হাজার কিলোমিটার উপকূল পাড়ি দিয়ে কচ্ছপগুলো শীত মৌসুমে বালুকাময় সৈকতে ডিম পাড়তে ছুটে আসে। সৈকতের কূলের কাছাকাছি এসে কচ্ছপগুলো জেলেদের পুঁতে রাখা নিষিদ্ধ জালে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে। কিছু মারা পড়ছে মাছ ধরার ট্রলার অথবা স্পিডবোটের ধাক্কা খেয়ে। ডিম পাড়তে আসা বেশির ভাগ কচ্ছপ জলপাই রঙের (অলিভ রিডলে)। এরা একসঙ্গে ৩০ থেকে ১২০টি পর্যন্ত ডিম পাড়ে। এসব মা–কচ্ছপের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে গবেষণা প্রয়োজন।
সমিতিপাড়া ও নাজিরারটেক এলাকার জেলে মনজুর আলম ও গিয়াস উদ্দিন বলেন, মহেশখালীর সোনাদিয়া থেকে টেকনাফের সেন্টমার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত প্রায় ১২০ কিলোমিটার উপকূলে পুঁতে রাখা হয়েছে অন্তত পাঁচ হাজার নিষিদ্ধ বিহিঙ্গি ও কারেন্ট জাল। গভীর সাগর থেকে ডিম পাড়তে কচ্ছপগুলো যখন উপকূলের দিকে ছুটে আসে, তখন জালে আটকা পড়ছে। এ সময় ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়া গর্ভবতী কচ্ছপগুলোকে লাঠি কিংবা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করে সাগরে নিক্ষেপ করেন জেলেরা। জোয়ারের সময় মৃতদেহগুলো সৈকতে ভেসে আসে। গভীর সাগরে মাছ ধরার ট্রলিং জাহাজের জালেও অসংখ্য মা–কচ্ছপ মারা যাচ্ছে। অনেকে পরিকল্পিতভাবে কচ্ছপ নিধন করে তার খোলস মিয়ানমারে পাচার করছে। কচ্ছপনিধন বন্ধে কারও উদ্যোগ নেই।
কক্সবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, জেলায় মাছ ধরার নৌযান রয়েছে প্রায় ছয় হাজার। নৌযানের জেলেদের নিষেধ করা আছে মাছ ধরার জালে কচ্ছপ আটকা পড়লে হত্যা না করে ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু তারপরও কচ্ছপ মারা যাচ্ছে। কেন কচ্ছপের মৃত্যু হচ্ছে এর কারণ অনুসন্ধানে কেউ নেই।
কক্সবাজার সদর উপজেলা জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মাঈন উদ্দিন আহমদ বলেন, উপকূলের নিষিদ্ধ জাল উচ্ছেদের জন্য মৎস্য বিভাগ ও কোস্টগার্ড প্রায় সময় অভিযান পরিচালনা করে। বিপুলসংখ্যক নিষিদ্ধ জাল জব্দ করে আগুনে ধ্বংসও করা হয়। তারপরও কচ্ছপের মৃত্যু রোধ করা যাচ্ছে না।
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আয়াছুর রহমান বলেন, সেন্ট মার্টিন, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং, নয়াপাড়া, মহেশখালীয়াপাড়া, বাহারছড়া, উখিয়ার মনখালী, ছেপটখালী, পাটোয়ারটেক, ইনানী, কক্সবাজারের হিমছড়ি, দরিয়ানগর, কলাতলী সৈকতসহ মহেশখালী ও সোনাদিয়া উপকূলে প্রতিদিন গড়ে ৫০-৬০টি মৃত কচ্ছপ ভেসে আসছে। গত ১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দুই মাসে অন্তত দেড় হাজার মৃত কচ্ছপ সৈকতে ভেসে আসে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ কচ্ছপের শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। অবশিষ্ট কচ্ছপ সৈকতে ডিম পাড়ার সময় কুকুরের আক্রমণে মারা গেছে। কচ্ছপ সংরক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা এ তথ্য দেন।
টেকনাফে রাজারছড়ার জেলে নবী হোসেন (৪০) বলেন, কচ্ছপ জালে আটকা পড়লে জাল ছিঁড়ে ফেলে। তাই জাল রক্ষার জন্য জেলেরা লাঠি বা ধারালো অস্ত্র দিয়ে দ্রুত আঘাত করে কচ্ছপ মেরে ফেলেন। এ ব্যাপারে জেলেদের সচেতন করার কেউ নেই।
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, গত সাত দিনে দ্বীপের সৈকতে ১০-১৫টি মৃত কচ্ছপ ভেসে আসে। অধিকাংশ কচ্ছপ কুকুরে খেয়ে ফেলে। অবশিষ্ট কচ্ছপ বালুচরে পুঁতে ফেলা হয়েছে। কচ্ছপ সম্পর্কে মানুষের ভ্রান্ত ধারণা দূর কিংবা নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার সম্পর্কে সরকারের নীতিমালা নিয়ে স্থানীয় জেলেদের ধারণা নেই।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, প্রতিবছর শীত মৌসুমে (ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত) কয়েক হাজার মা–কচ্ছপ গভীর সমুদ্র থেকে ডিম পাড়তে উপকূলের বালুচরে ছুটে আসে। কিন্তু উপকূলে পুঁতে রাখা জেলেদের জাল ও গভীর সাগরে ট্রলারের জালে আটকা পড়ে কচ্ছপ। কিছু কচ্ছপ সাগর সাঁতরে কূলে উঠলেও ডিম ছাড়তে পারে না। ক্লান্ত কচ্ছপগুলো উপকূলে এসেই কুকুরের আক্রমণের শিকার হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. শাহ আলম বলেন, জালে আটকা পড়া কচ্ছপ দু-তিন ঘণ্টা জীবিত থাকতে পারে। কিন্তু জেলেরা পিটিয়ে মা–কচ্ছপ হত্যা করে সাগরে নিক্ষেপ করছে। কচ্ছপ সমুদ্রের ময়লা-আবর্জনা খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। তাদের বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব সবার।