টেকনাফে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে আনসারুল্লাহ !

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পক্ষে লড়াই করার লক্ষ্যে নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। এ লক্ষ্যে গোপন এই জঙ্গি সংগঠন অস্ত্র-বিস্ফোরক সংগ্রহ শুরু করেছে।
পুরান ঢাকার বংশালে মঙ্গলবার রাতে গ্রেপ্তার হওয়া আনসারুল্লাহর এক সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে বলে ঢাকা মহানগর কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একটি সূত্র জানিয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া তরুণের নাম যুবায়ের। তাঁর বাড়ি কামরাঙ্গীরচরে। যুবায়েরের কাছে থাকা ব্যাগে বিস্ফোরক ও অ্যাসিড পাওয়া গেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি পুলিশকে বলেছেন, বোমা তৈরির উপকরণগুলো তাঁদের আরেকটি দলের কাছে পৌঁছাতে যাচ্ছিলেন। ওই দলটি রোহিঙ্গাদের সহায়তার লক্ষ্যে টেকনাফে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
গ্রেপ্তারের ঘটনা সম্পর্কে বংশাল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আলী রেজা বলেন, মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে যুবায়ের ও তাঁর দুই সঙ্গী মোটরসাইকেলে করে মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। সন্দেহ হওয়ায় টহলে থাকা পুলিশের দুজন সদস্য তাঁদের থামতে বলেন। চালক মোটরসাইকেল না থামিয়ে পুলিশের ওপর অ্যাসিড ছুড়ে মারেন। এতে কনস্টেবল আবদুস সালাম আহত হন। সঙ্গে থাকা এসআই নুরুজ্জামান মোটরসাইকেলটি ধাওয়া করে একজনকে ধরে ফেলেন। বাকি দুজন দৌড়ে পালিয়ে যান।
বংশাল থানার পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তারের সময় ধস্তাধস্তিতে পড়ে গিয়ে এসআই নুরুজ্জামানের মাথা ফেটে যায়। এ সময় ওই জঙ্গির পায়ে গুলি করে আটক করা হয়, তাঁকে পুলিশের পাহারায় হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আর তাঁর ছোড়া অ্যাসিডে দগ্ধ হওয়া পুলিশ সদস্য আবদুস সালাম ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে চিকিৎসাধীন আছেন।
এ ঘটনায় বংশাল থানায় গতকাল বৃহস্পতিবার দুটি মামলা হয়েছে। একটি পুলিশের ওপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে, অপরটি বিস্ফোরক আইনে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ গ্রেপ্তারের পর যুবায়েরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এই বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিকভাবে তাঁরা জানতে পেরেছেন যে যুবায়ের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (বর্তমান নাম আনসার আল ইসলাম) সদস্য। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে যুবায়ের বলেছেন, অ্যাসিড ও গানপাউডার সংগঠনের একটি আস্তানায় অন্য সদস্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তাঁর। সেখান থেকে বোমা তৈরির এসব উপাদান টেকনাফে নেওয়ার কথা ছিল। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে, তাঁদের সহায়তায় আনসারুল্লাহ সংগঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাঁরা মিয়ানমারে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিবাদে যুক্ত আছেন এমন কিছু ব্যক্তির কক্সবাজার ও টেকনাফ এলাকায় আনাগোনার আভাস তাঁরা পাচ্ছেন।
মা জাকিয়া বেগম গতকাল বলেন, তাঁর ছেলে কাদের সঙ্গে মিশতেন, সে ব্যাপারে তিনি জানেন না। তবে তাঁকে ছেলে এক বন্ধুপ্রতিম বড় ভাইয়ের কথা জানিয়েছিলন। ওই বড় ভাইয়ের নামও যুবায়ের। তিনি একজন ‘সরকারি লোক’, টেকনাফে থাকেন।
জাকিয়া বলেন, ‘গতকাল হাসপাতালে ছেলের কাছে গিয়ে আমি শুনলাম, সে ও তার বন্ধুরা টেকনাফে যাচ্ছিল। টেকনাফের যুবায়ের (সরকারি লোক) তাদের ডেকে পাঠিয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে যে কাজ করেছে, তার জন্য শাস্তি হওয়া দরকার। কিন্তু এই সরকারি লোক যুবায়েরটা কেন এমন করল? এখন কী হবে?’
যুবায়েরের মা জাকিয়া বেগম গতকাল বলেন, যুবায়ের প্রথমে পুরান ঢাকার ফরিদাবাদ মাদ্রাসায় ও পরে চট্টগ্রামের হাটহাজারি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছেন। কিছুদিন আগে মাদ্রাসা থেকে পাস করে পাগড়ি নিয়ে আসেন যুবায়ের। এরপর আরও পড়ালেখা করছেন বলে পরিবারকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোথায় লেখাপড়া করছেন, সেটা খুলে বলেননি। শুধু জানিয়েছিলেন মুফতি হতে চান।
জাকিয়া বেগম বলেন, তাঁর ছেলে সকালে মাদ্রাসায় যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হতেন, ফিরতেন রাতে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে যুবায়ের বন্ধুর মোটরসাইকেল ফেরত দিতে যাচ্ছেন বলে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি। রাত দুইটার দিকে কেউ একজন তাঁকে ফোন করেন। ফোনের অপর প্রান্তে কাউকে জেরা করতে শোনেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। পরদিন জানতে পারেন ছেলে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
পারিবারিক সূত্র জানায়, যুবায়েরদের বাসা রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে হলেও পুরান ঢাকার মাহুতটুলিতে তাঁদের পৈতৃক একটি বাড়ি আছে। ওই বাড়িতে বড় কাটারা মাদ্রাসার দুই ছাত্র ভাড়া ছিলেন। যুবায়ের মাঝেমধ্যে তাঁদের সঙ্গে গিয়ে থাকতেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যুবায়েরের বাবা-মা ওই দুই ছাত্রকে ভাড়া মিটিয়ে অন্যত্র চলে যেতে বলেন। পরদিন সকালবেলা যুবায়েরের বাবা ছেলের খোঁজে মাহুতটুলির বাসায় গেলে ওই দুই ছাত্রকে আর পাননি।
যুবায়ের একই নামের কোনো এক সরকারি চাকরিজীবীর কাছে টেকনাফে যাচ্ছিলেন। তাঁর মায়ের এই তথ্যের বিষয়ে গ্রেপ্তার যুবায়েরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আর কিছু জানা গেছে কি না বা ওই কথিত সরকারি চাকরিজীবীকে শনাক্ত করা গেছে কি না, জানতে চাইলে বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘তদন্ত নিয়ে কোনো কথা বলা এখন সম্ভব না।’ তিনি বলেন, এ ঘটনায় করা দুটি মামলায় গ্রেপ্তার যুবায়েরসহ তিনজনকে আসামি করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে আহেমদ রাজীব হায়দারকে হত্যার মধ্য দিয়ে প্রথম আলোচনায় আসে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। ওই বছরের আগস্টে সংগঠনটির প্রধান মুফতি জসিমউদ্দিন রাহমানী বরগুনায় গ্রেপ্তার হন। তখন তিনি রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবদে জানিয়েছিলেন, ২০১২ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত দাঙ্গার সময় এ দেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার জন্য ত্রাণ সংগ্রহ করেছিল আনসারুল্লাহ। ট্রাকভর্তি ওই ত্রাণ কক্সবাজারে পৌঁছানোর আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করে ফেলে।
২০১৪ সাল থেকে এই সংগঠন আবার ব্লগার, শিক্ষক, প্রকাশক হত্যা শুরু করে। সংগঠনটি নাম পরিবর্তন করে আনসার আল ইসলাম নাম ধারণ করে এসব হত্যার দায়ও স্বীকার করেছিল। সংগঠনটি নিজেদের আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলাদেশ শাখা দাবি করে থাকে।
গত বছরের ২৫ এপ্রিল ঢাকার কলাবাগানের বাসায় ঢুকে সমকামীদের অধিকারকর্মী ও ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তাঁর বন্ধু মাহবুব রাব্বীকে হত্যা ঘটনার দায় স্বীকার করে আনসার আল ইসলাম। এরপর সংগঠনটির আর কোনো তৎপরতা দৃশ্যমান হয়নি। সেনাবহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক এই গোপন সংগঠনটির কথিত সামরিক শাখার প্রধান বলে বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছেন। তবে তাঁকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ