দলীয় কোন্দলেই নিহত আদনান
প্রতিবেদক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ
২০০১ সালেই প্রথম ‘কাকড়া গ্যাং’ নামে এই গ্যাং কালচার শুরু হয়। এর হাত ধরে বিগ বস, নাইন স্টার সহ ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠা পায় ‘ডিসকো বয়েস গ্রুপ’। কিশোরদের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এইসব গ্যাংয়ের/ দলের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধের জেরে খুন হন আদনান।
গতাকাল বুধবার ০৮ (ফেব্রুয়ারী) দুপুর ১২টায় কাওরান বাজারের বিএসইসি ভবনের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান এ কথা জানান। ব্রিফংএ র্যা ১ এর সিও লেফটেনেন্ট কর্নেল সারওয়ার এবং আরো উপস্থিত ছিলেন র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান লেফটেনেন্ট কর্নেল মোহাম্মাদ আবুল কালাম আজাদ।
তিনি বলেন, র্যাব প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সমাজের বিভিন্ন অপরাধ এর উৎস উদ্ঘাটন, অপরাধীদের গ্রেফতারসহ আইন শৃংখলার সামগ্রিক উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। র্যাবের সৃষ্টিকাল থেকে চাঁদাবাজ, সন্ত্রাস, খুনি, বিপুল পরিমান অবৈধ অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার, ছিনতাইকারী, অপহরণ ও প্রতারকদের গ্রেফতার করে সাধারণ জনগণের মনে আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় মঙ্গলবার রাতভর অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার আটজন কথিত ‘ডিসকো বয়েজ’ ও ‘বিগ বস’ গ্যাং এর সদস্য। আদনান হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
রযবের এ পরিচালক বলেন, ‘গ্যাং কালচারের’ নামে দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে রাজধানীর উত্তরা এলাকার কিশোরদের একটা অংশ। ‘নাইন স্টার’ ও ‘ডিসকো বয়েজ’ নামে সক্রিয় এসব কিশোর শুরুতে মূলত ‘পার্টি’ করা, হর্ন বাজিয়ে প্রচণ্ড গতিতে মোটরসাইকেল চালানো ও রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার কাজে যুক্ত ছিল। বছর খানেক ধরে তারা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িত হয়েছে, যার সর্বশেষ শিকার উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির।
অভিযানে আটক, ডিসকো বয়েস গ্যাং গ্রুপের দলনেতা শাহরিয়ান বিন সাত্তার সেতু ওরফে রায়হান আহম্মেদ সেতু ওরফে ডিসকো সেতুর নেতৃত্বে মুখে কালো কাপড় বেধে রাজধানীর উত্তরায় স্কুলছাত্র আদনান কবীরকে হত্যা করে বলেও প্রাথমিক ভাবে নিশিত হয়েছে র্যাব।
মুফতি মাহমুদ আরো জানান, উত্তরায় গড়ে ওঠা কিশোরদের গ্যাংয়ের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধের জেরে আদনান খুন হন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ওই এলাকায় কিছু কিশোর-তরুণের গ্রুপ রয়েছে এবং আদনান কবীরও একটি গ্রুপের সঙ্গে চলা ফেরা করত ও তাদের দ্বন্দ্বের জেরেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ।
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখ রাত ২২৩৫ ঘটিকার সময় র্যাব-১, উত্তরা’র সিও ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল সারওয়ার এর তত্ববাধায়নে আভিযান পরিচালিত হয়। এতে উত্তরা সেক্টর-১৪, রোড নং-১৭ এলাকায় অভিযানে চাঞ্চল্যকর আদনান হত্যা মামলায় জড়িত ০৮ আসামিদের আটক করা হয়। এর মধ্যে ডিস্কো বয়েস গ্রুপের গ্যাং লিডার শাহরিয়ার বিন সাত্তার (সেতু) সহ ০২ জন । বিগবস গ্রুপের গ্যাং লিডার মোঃ আক্তারুজ্জামান ছোটনসহ ০৬ জন। আটককৃতদের মধ্যে ছোটনের নামে পূর্বে মামলা রয়েছে বলে জানায়। সেতু বর্তমানে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির বিবিএ তে অধ্যায়নরত। তার পিতা। এয়ারপোর্টের একজন সি এন্ড এফ এজেন্ট। সে উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ডিসকো গ্রুপের অপর সদস্য জুইস বর্তমানে উত্তরা স্কুল এন্ড কলেজের দশম শ্রেনীর ছাত্র। তার পিতা একজন মুদি ব্যবসায়ী। অন্যদিকে বিগবস্ গ্রুপের আটক সদস্যরা নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য, এদের মধ্যে ছোটন ইউনিক এ্যাডুকেয়ারে ১০ শ্রেণীর ছাত্র এবং সুমন এইচএসসি পাশ বলে দাবী করে ; তবে অন্যন্যদের স্কুলে যাতায়াত নেই বললেই চলে। এদের মধ্যে বিগবস গ্রুপের গ্যাংলিডার ছোটন এবং সুমন দুই ভাই এরা হকার ব্যবসা করে। অন্যান্যদের মধ্যে সানি ইজি বাইক চালক, সেলিম গার্মেন্টসে চাকুরী, রমজান সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া ব্যবসার কর্মচারী ও শাহীন ট্রান্সপোর্ট চাকুরী করে বলে জানায়।
আটককৃত আসামিদের গ্যাং পরিচয় সম্পর্কে জানা যায় যে, ২০০৯ সালে সেতুর নেতৃত্বে ডিস্কো বয়েস গ্রুপ আত্মপ্রকাশ করে। এই গ্রুপটির মূলত উত্তরা এলাকায় আধিপত্য রয়েছে। অন্যদিকে ২০১৬ সালের শুরুর দিকে ছোটনের নেতৃত্বে ডিস্কো গ্রুপের সহযোগী গ্রুপ হিসেবে বিগবস্ গ্রুপের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরা মূলত উত্তরার শেষাংশসহ আব্দুল্লাহপুর, বেড়িবাদ, কোটবাড়ি, ফায়দাবাদ ইত্যাদি এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে। এদের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যাং গ্রুপ নাইন স্টার গ্রুপ তালাচাবি রাজুর নের্তৃত্বে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই গ্যাংটির উত্তরা সেক্টর -১২,১৩,১৪, খালপাড়, দিয়াবাড়ি এবং বাউনিয়া এলাকায় আধিপত্য রয়েছে। গ্যাংগুলোর এক একটির সক্রিয় সদস্য ২০/২৫ জন। এই গ্যাং গুলোর মধ্যে সম্প্রতি কিছু উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
এসব কিশোর অপরাধী ‘গ্যাংয়ের’ ব্যাপারে তাদের অভিভাবক এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবাই ছিলেন উদাসীন। উত্তরার ১৯ নম্বর সেক্টরের একাধিক বাসিন্দা জানান, বছর দুয়েক ধরে তারা এসব কিশোর বখাটের উৎপাত দেখে আসছেন। তাদের উচ্চগতির মোটরসাইকেলের রেস পথচারীদের আতঙ্কের কারণ ছিল। তবে দুই দলের প্রধানের বয়স কুড়ি-বাইশ বছর।
সাম্প্রতিক সময়ে এই তিনটি গ্যাং ও তাদের সহযোগী গ্যাংদের মধ্যে বিবিধ কারণে কোন্দল বিরাজ করছিল আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানাগেছে বলে জানিয়েছে রযাব। এর ধারাবাহিকতায় গত ০৩/০১/২০১৭ ইং তারিখ ডিস্কো বয়েস গ্রুপ ও বিগবস্ গ্রুপের সদস্যরা নাইনস্টার গ্রুপের গ্যাং লিডার রাজুকে ১৩নং সেক্টর ব্রিজের উপর ব্যাপক মারধর করে মারাত্বকভাবে আহত করে। এর প্রতিউত্তরে গত ০৫/০১/২০১৭ ইং তারিখে আজমপুর ফুট ওভার ব্রিজের গোড়ায় নাইনস্টার গ্রুপের সদস্যরা আবার বিগবস গ্রুপের গ্যাং লিডার ছোটনকে আক্রমণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৬/১/২০১৭ তারিখ ১৩ নং সেক্টরের ১৭ নং রোডের ১৫ নং বাড়ি সামনে ডিস্কো বয়েস গ্রুপ ও বিগবস্ গ্রুপের সদস্যরা আদনান কবির (১৪) কে ধারালো অস্ত্র ও হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করে ফলে আদনানের মৃত্যু হয় । আসামিরা জানিয়েছে তাদের মূল লক্ষ্য ছিল নাইন স্টার গ্রুপের রাজুকে আঘাত করা।
উল্লেখ্য, গত ৬ জানুয়ারি বিকেল সাড়ে ৫ টার দিকে ১০/১৫ জন তরুণ ধাওয়া করে আদনানকে ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়। হাসপাতালে নেওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তার মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় আদনানের বাবা মো. কবির হোসেন উত্তরা পশ্চিম থানায় নয়জনের নাম উল্লেখ করে আরও ১০/১২ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। আসামিদের সবার বয়স ১৬ থেকে ২২ বছরের মধ্যে। নিহত আদনান উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিল ।