৩০ ঘণ্টা অন্ধকার বাথরুমে কাটিয়েছি
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: ‘অন্ধকার বাথরুমে কত সময় থাকা যায়। আমরা স্বামী-স্ত্রী চরম আতঙ্ক আর মৃত্যুভয় নিয়ে ২৫ থেকে ৩০ ঘণ্টা কাটিয়েছি। বারবার মনে হচ্ছিল,এই বুঝি জঙ্গিরা দরজা ভেঙে ঢুকে আমাদের গুলি করবে। বাঁচার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। মায়ের পেট থেকে জন্ম নেওয়ার সময় বুঝিনি কীভাবে দুনিয়াতে আসছি, এখন বুঝতে পারছি জন্ম কাকে বলে, সেখান থেকে ফিরে মনে হচ্ছে যেন দ্বিতীয় জন্ম পেয়েছি।’
সিলেটের শিববাড়ির জঙ্গি আস্তানা ‘আতিয়া মহল’ থেকে ফিরে আসা স্কুলশিক্ষক কান্তা ভট্টাচার্য এভাবেই বলছিলেন সেদিনের আতঙ্কের কথা।
কান্তা ভট্টাচার্যের স্বামী উজ্জ্বল চক্রবর্তী (৩৭) সিলেট ফায়ার স্টেশনের নিয়ন্ত্রণকক্ষে কাজ করেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে আতিয়া মহলের চতুর্থ তলার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। তাঁদের বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার নন্দনগর গ্রামে। এখন তাঁরা গ্রামের বাড়িতে আছেন। আজ মঙ্গলবার দুপুরে মোবাইলে কথা হয় দুজনের সঙ্গে।
উজ্জ্বল চক্রবর্তী জানান, বৃহস্পতিবার রাতে প্রতিদিনের মতো খাওয়াদাওয়া শেষে দুজন ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে ঘুম থেকে উঠে কান্তা রান্নাঘরে যান। জানালা খুলে দেখেন নিচে বহু পুলিশ তাঁদের বাড়ির দিকে বন্দুক তাক করে আছে। কান্তা বিষয়টি তাঁকে জানালে তিনি সিলেটের পরিচিত এক পুলিশকে ফোন দেন। তখন জানতে পারেন যে তাঁদের ভবনে জঙ্গি আস্তানা আছে। সে জন্য ভবনটি ঘেরাও করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ‘ভাই, তখন আমার ভেতর শুকিয়ে যায়। আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়ি। কী কবর কিছু বুঝতে পারছিলাম না।’ বলছিলেন উজ্জ্বল।
সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে উজ্জ্বল বলেন, সকাল সোয়া সাতটার দিকে ভবনের ভেতরে বিকট শব্দ শুনে তাঁদের আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। এ সময় ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি কানে আসে। তখন বাইরে থেকে পুলিশ মাইকে বলতে থাকে দরজা-জানালা ভালো করে বন্ধ রাখতে এবং কেউ যেন দরজা বা জানালার কাছে না থাকেন। এরপর আরও কয়েকটি গুলির শব্দ শোনেন তাঁরা। একপর্যায়ে সকাল সাতটার দিকে নিরাপদ মনে করে ঘরের একটি বাথরুমে দুজন আশ্রয় নেন। সেখান থেকে মোবাইলে বাড়িতে বিষয়টি জানান। তখন আবার মাইকে পুলিশের কথা শোনেন। পুলিশ মর্জিনাকে বের হওয়ার জন্য বলছিল। সারা দিন বাথরুমে থেকে থেমে থেমে বিকট শব্দ ও গুলির আওয়াজ শুনেছেন তাঁরা।
উজ্জ্বল চক্রবর্তী বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যার পর গুলির আওয়াজ বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের মনে হচ্ছিল হয়তো বাঁচার আর কোনো আশা নেই। গভীর রাতে ঘরের বাইরে সিঁড়িতে মানুষের পায়ের আওয়াজ শুনে বুক ধড়ফড় করে ওঠে, এই বুঝি জঙ্গিরা দরজা ভেঙে ঘোরে ঢুকল। চরম উৎকণ্ঠায় রাত কাটে তাঁদের।
কান্তা ভট্টাচার্য বলেন, বাথরুমে রাতে একসময় উজ্জ্বল অজ্ঞান হয়ে পড়েন। অনেকক্ষণ পর তাঁর জ্ঞান ফেরে। তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি বাথরুম থেকে বের হয়ে কিছু চিড়া আর মুড়ি নিয়ে আবার বাথরুমে ঢোকেন। বলেন, ‘ঘরে ভাত-মাছ সবই ছিল। কিন্তু খেতে পারছিলাম না। ভেতরে কিছুই যাচ্ছিল না। আমাদের ভয় ছিল, জঙ্গিরা মারবে নাকি বাইরে থেকে আসা গুলিতে মরব।’
শনিবার সকাল আটটার দিকে বাড়ির মালিকের ফোন থেকে উজ্জ্বলের মোবাইলে কল আসে। তিনি ফোন ধরে আস্তে করে কথা বলেন। অপর প্রান্ত থেকে সেনাবাহিনীর পরিচয়ে একজন তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলেন। তখন উজ্জ্বলের মনে বাঁচার আশা জাগে। উজ্জ্বল বলেন, ‘এই ফোন পাওয়ার পর মনে কিছুটা শান্তি আসে। মনে হচ্ছিল, সেনাবাহিনী আমাদের উদ্ধার করবেই।’ ফোনে তাঁকে জানানো হয়, দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনলে যেন আস্তে করে খুলে দেওয়া হয়। বলা হয়, কোনো কিছু সঙ্গে না নিয়ে দুই হাত ওপরে তুলে খালি পায়ে বের হতে।
এরপর তাঁরা অপেক্ষায় থাকেন কখন দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হবে। শনিবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে দরজায় সেই শব্দ শুনতে পান তাঁরা। উজ্জ্বল বলেন, ‘সেনাবাহিনী না জঙ্গি, সেই চিন্তা না করে বুকে সাহস নিয়ে দরজা খুলি। যখন দেখি সেনাবাহিনী, তখন কান্না এসে যায়। এরপর তাদের সঙ্গে আস্তে আস্তে বের হয়ে আসি।’
সেনাবাহিনী তাদের উদ্ধার করে পাশের ভবনের একটি কক্ষে নিয়ে যায়। ওই কক্ষে ২০ থেকে ২৫ জন পুরুষ ছিলেন। অন্য আরেকটি কক্ষে যেটিতে নারীদের রাখা হয়েছিল, সেখানে কান্তাকে নেওয়া হয়। সেনাসদস্যরা প্রথমে তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন এবং যাঁদের প্রয়োজন তাঁদের ওষুধ দেন। পরে শনিবার রাত আটটার দিকে ওই কক্ষ থেকে নিজের স্বজনদের কাছে তাঁদের দেওয়া হয়।
কান্তা ভট্টাচার্য বলছিলেন, বাড়ির বাসিন্দারা সবাইকে এক জায়গায় দেখে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেনাবাহিনীর সদস্যরা তখন ‘আর কোনো ভয় নাই’ বলে সান্ত্বনা দেন। দীর্ঘ সময় এক জায়গায় বসে থাকায় কান্তার পা ফুলে গেছে, এখন হাঁটতে পারছেন না তিনি।
উজ্জ্বল চক্রবর্তী ও কান্তা ভট্টাচার্য যখন এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তাঁরা গ্রামের একটি মন্দিরে ছিলেন। উজ্জ্বল বলেন, ‘মা-বাবা আর দেশবাসীর দোয়ায় বেঁচে এসেছি। প্রধানমন্ত্রী ও আমাদের সেনাবাহিনীর কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তবে এখনো স্বাভাবিক হতে পারছি না। মাথায় শুধু সেই ৩০ ঘণ্টার কথা ঘুরপাক খায়। মন থেকে ভয়-আতঙ্ক দূর করতে পারছি না।’
শেষ কথায় কান্তা ভট্টাচার্য বলেন, ‘ভাই, ঈশ্বর বাঁচিয়েছেন। সে জন্য মন্দিরে এসেছি। জীবনে যেন কোনো দিন এ রকম পরিস্থিতিতে আর না পড়ি, কেউ যেন না পড়ে, সেই প্রার্থনাই করছি।’