সাত দেহ ছিন্নভিন্ন

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: প্রায় ৩৪ ঘণ্টা ঘিরে রাখার পর মৌলভীবাজারের নাসিরপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে ‘ছিন্নভিন্ন সাত থেকে আটজনের লাশের অংশ’ পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশের ধারণা, গত বুধবার বিকেলেই আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তারা নিহত হয়। তারা একই পরিবারের সদস্য। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে পুলিশের ‘অপারেশন হিট ব্যাক’ সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।
অভিযান শেষে সংবাদ ব্রিফ্রিংয়ে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, বাংলো ধাঁচের ওই টিনশেড একতলা বাড়ির বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) ছড়িয়ে রাখা হয়েছিল। সেগুলো সরিয়ে এবং বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিষ্ক্রিয় করার পর ভেতরে ঢুকে মানুষের দেহের বিভিন্ন অংশ ছড়ানো অবস্থায় পাওয়া যায়।
এদিকে মৌলভীবাজারের অন্য জঙ্গি আস্তানাটি এখনো ঘিরে রেখেছে পুলিশ। বুধবার ওই আস্তানা থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়া হলেও গতকাল দোতলা ওই বাড়ি থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি। গোলাগুলি বা বিস্ফোরণের শব্দও শোনা যায়নি দিনভর।
মৌলভীবাজার সদর হাসপাতাল সূত্র বলেছে, লাশগুলো ছিন্নবিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিল। সেখান থেকে তারা চারটি শিশু, দুই বয়স্ক মহিলা এবং এক পুরুষের লাশ চিহ্নিত করতে পেরেছে।
মৌলভীবাজার জেলা পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, মঙ্গলবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে তাঁরা মৌলভীবাজার শহরের বড়হাট আবুশাহ দাখিল মাদ্রাসা গলিতে দোতলা বাড়িটি জঙ্গি আস্তানা হিসেবে শনাক্ত করে ঘিরে রাখেন। ওই বাড়ি ঘিরে রাখার পরে সেখানকার তত্ত্বাবধায়কের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে বুধবার ভোরে শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে নাসিরপুর গ্রামের জঙ্গি আস্তানাটি শনাক্ত করা হয়।
গতকাল বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে নাসিরপুরের জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শেষে ১ নম্বর খলিলপুর ইউনিয়ন কমপ্লেক্স ভবনে ব্রিফ করেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা একটা সূত্র ধরে কাজ করছিলাম। নিহত ব্যক্তিরা নব্য জেএমবির সদস্য, সেটা আমরা মোটামুটি নিশ্চিত।’ তিনি বলেন, বাসার তত্ত্বাবধায়কের তথ্যমতে ওই ভবনে নিহত ব্যক্তিরা সবাই একই পরিবারের সদস্য। তবে পুলিশ সে তথ্য যাচাই-বাছাই করতে পারেনি।
এর আগে বুধবার বাসাটির তত্ত্বাবধায়ক জানিয়েছিলেন, গত জানুয়ারি মাসে মাহফুজ পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি ওই বাড়ি ভাড়া নেয়। বাড়িতে মাহফুজের স্ত্রী, শ্বশুর, শাশুড়ি, চার শ্যালিকাসহ আটজন ছিল। শ্যালিকাদের দুজন শিশু।
সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল ইসলাম বলেন, সিলেটে ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ চলাকালে শিববাড়ি এলাকায় যে দুটি বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্ত করতে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের ছোট একটি অংশ এখানে কাজ শুরু করে, তারা মৌলভীবাজারের বড়হাটের জঙ্গি আস্তানার খোঁজ পায়। এখানে অভিযানে যাওয়ার পর নাসিরপুরের জঙ্গি আস্তানাটির তথ্য তাদের কাছে যায়। তখন পুলিশ ওই বাড়িটিও ঘিরে ফেলে। নাসিরপুরের আস্তানাটি আত্মগোপনের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তিনি বলেন, নাসিরপুরের এই আস্তানা ঘেরাও করার পর থেকে ১২টির মতো বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সর্বশেষ বুধবার বিকেলে যখন সোয়াট অভিযান শুরু করে, তখন সোয়াট মাইকের মাধ্যমে তাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। ঠিক ওই সময়টাতেই বাড়িটির ভেতর থেকে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। সেই বিস্ফোরণে মূল দরজা ও জানালার কাচ ভেঙে যায়। একপর্যায়ে অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় বিরতি টানা হয়।
মনিরুল বলেন, গতকাল ভোরবেলা থেকে অভিযান শুরুর কথা থাকলেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে দেরিতে শুরু হয়। জঙ্গিরা বাড়িটির প্রবেশপথসহ বিভিন্ন জায়গায় বিস্ফোরক (আইইডি) ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছিল। পরে গতকাল ড্রোনের মাধ্যমে বাইরে থেকে ছবি দেখে অবস্থান শনাক্ত করা হয়। সেগুলো অপসারণ করা হয়। সেখানে লাশগুলো বীভৎস অবস্থায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। সোয়াট যখন অভিযান শুরু করে, তখনই তারা সেই শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মহনন করে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, ডেড বডি কোনোটাই অক্ষত নেই। ছিন্নভিন্ন হয়ে দুটো রুমে ছড়িয়ে আছে। মাথা-পা একেকটা একেক জায়গায়। সেগুলো থেকে গন্ধ বের হচ্ছে। সব মিলিয়ে সাত থেকে আটটি বডির অংশবিশেষ হতে পারে। বিভিন্ন বয়সের পুরুষ-নারী আছে। দু-একজন অপরিণত বয়স্কও থাকতে পারে। হাত-পা দেখে এ রকমই মনে হয়েছে।
মনিরুল বলেন, ‘জঙ্গিদের এ কৌশল নতুন নয়, যখনই তারা দেখে পালানোর পথ নেই, তখনই তারা নিজেদের উড়িয়ে দেয়। বুধবার সকালে বাড়িটি ঘিরে ফেলার সময়ই তারা গ্রেনেড হামলা করে পালানোর চেষ্টা করে।’
বুধবার বিকেলে নিহত হওয়ার কথা জানালেও বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে সোয়াট যাওয়ার পর থেকে বেলা সোয়া একটা পর্যন্ত থেমে থেমে বা একনাগাড়ে তিন শতাধিক গুলির শব্দ শোনা যায়।
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, বুধবার বিকেলেই তারা নিহত হয়েছে। যদি সবাই আত্মঘাতী হয়ে থাকে, তাহলে বুধবার রাতে ও বৃহস্পতিবার দিনে বাড়িটি লক্ষ্য করে এত গুলি ছোড়া হলো কেন—জানতে চাইলে মনিরুল বলেন, ‘এটি সোয়াটের অভিযান পরিচালনার কৌশল। তাদের যে এসওপি, ট্রেনিং ম্যানুয়াল, সেগুলো অনুযায়ী অভিযান পরিচালনা করে। যেহেতু নির্দিষ্ট তথ্য ছিল না, তাই এটা হতেই পারে।’
নাসিরপুরের জঙ্গি আস্তানায় যে বিস্ফোরক পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে অন্য স্থানে পাওয়া বিস্ফোরকের কোনো মিল আছে কি না, জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, সীতাকুণ্ড ও বিমানবন্দর গোলচত্বর এলাকায় আত্মঘাতী যুবকের কাছে যে অবিস্ফোরিত বোমা পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলোর সঙ্গে এসব বিস্ফোরকের হুবহু মিল পাওয়া গেছে।
নাসিরপুরের এই আস্তানার বাসিন্দারা স্থানীয় কি না—জানতে চাইলে মনিরুল বলেন, এরা স্থানীয় নয়। কারও সঙ্গে মিশত না।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ওই বাড়িতে সোহেল নামে একজন ছিল। সে নিহত হয়েছে বলে তাঁদের কাছে তথ্য রয়েছে।
ব্রিফিংয়ে অন্যদের মধ্যে ছিলেন সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি কামরুল আহসান, সিলেটের অতিরিক্ত ডিআইজি নজরুল ইসলাম, মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহজালাল, কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের উপকমিশনার প্রলয় কুমার জোয়ার্দার প্রমুখ।
‘অপারেশন হিট ব্যাক’ শেষ হওয়ার পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিট ঘটনাস্থলে গেছে আলামত সংগ্রহের জন্য।
বুধবার সন্ধ্যায় সোয়াট নাসিরপুরের ওই বাড়িতে অভিযান শুরু করে। সন্ধ্যায় ৫৪ মিনিটে চার শতাধিক গুলির শব্দ শোনা যায়। পরে রাতে অভিযানে বিরতি দেওয়া হয়। ওই অভিযানের পর থেকে মূলত বাড়িটিতে কোনো সাড়াশব্দ ছিল না। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, বুধবার বিকেলেই জঙ্গিরা আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মহত্যা করে। এরপরও সতর্কতার সঙ্গে বৃহস্পতিবার ভোরে অভিযান চালিয়ে ভবনটি নিরাপদ করা হয়।
গতকাল বেলা ১১টার দিকে মৌলভীবাজারের বড়হাটে জঙ্গি আস্তানা এলাকায় যান কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। তখন তিনি বলেন, নাসিরপুরের জঙ্গি আস্তানায় অভিযান শেষ করার পর বড়হাটের জঙ্গি আস্তানায় অভিযান পুরোদমে শুরু করা হবে।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ