সাক্কুর জিত আর বিএনপির ধারাবাহিক হার !
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী জয় পেয়েছেন—এ খবর পুরোনো। এখন কিছু হিসাব-নিকাশের পালা। বিএনপির প্রার্থী তো জিতল, কিন্তু বিএনপি কি জিতল? মানে এ নির্বাচনে বিএনপির জয় জাতীয় রাজনীতিতে দলটির জন্য কোনো সুবিধা নিয়ে এল কি? রাজনীতির হিসাব-নিকাশ এমনিতেই জটিল বিষয়। আর বাংলাদেশের রাজনীতি তো এক জটিলতর অবস্থার মধ্যে ডুবে আছে। হিসাব-নিকাশগুলো তাই আর সরল অঙ্কে চলে না। আর আমাদের মনের মধ্যেও হয়তো জটিলতা এই মাত্রায় ভর করেছে, কোনো কিছুকে আমরা আর সহজভাবে দেখতে পারছি না। অথবা সরলভাবে বিবেচনা করার ক্ষমতা হারিয়েছি। বিএনপির প্রার্থীর জয়কে তাই দলটির জয় মনে হয় না। আবার আওয়ামী লীগের প্রার্থীর হেরে যাওয়াকেও দলের পরাজয় বিবেচনা করা যাচ্ছে না।
কুমিল্লা নির্বাচনে বড় ধরনের কোনো অনিয়মের খবর পাওয়া যায়নি। তবে সরকারি দল আওয়ামী লীগের জোরদার উপস্থিতি ও দাপট লক্ষণীয় ছিল। আর সারা দেশে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা বিএনপির উপস্থিতি ছিল সে তুলনায় বেশ মলিন। আমাদের দেশের নির্বাচনে এগুলোর গুরুত্ব আছে, নির্বাচনের ফলাফলে এসবের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এরপরও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হেরেছেন। জাতীয় রাজনীতিতে এ ধরনের নির্বাচনের একটি ভূমিকা থাকে। সবকিছু মিলিয়ে হিসাব-নিকাশ করলে প্রার্থী হারলেও এই নির্বাচনের ফলাফলকে কাজে লাগানোর যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, তাতে দল হিসেব জয় আওয়ামী লীগেরই। সে আলোচনায় পরে আসছি।
এর আগে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী জয়ী হয়েছেন। দুটি নির্বাচনই সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করেছেন সহকর্মী সোহরাব হাসান। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্যতার বিচারে দুটি নির্বাচনের মধ্যে কোনটিকে আপনি এগিয়ে রাখবেন? তাঁর দ্বিধাহীন উত্তর-নারায়ণগঞ্জ। তাঁর এই পর্যবেক্ষণকে যথার্থ বলে ধরে নিলে এটা মানতে হবে যে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সহজেই জিতেছেন। আর কুমিল্লায় দলটি নিজেদের দাপুটে উপস্থিতির মাধ্যমে যথেষ্ট চেষ্টা-চরিত করেও প্রার্থীকে জেতাতে পারেনি। সামনে জাতীয় নির্বাচন আসছে, এ অবস্থায় সরকার, সরকারি দল বা নির্বাচন কমিশনের জন্য গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাড়তি তাগিদ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে নতুন নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা ও ভাবমূর্তির জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ নির্বাচন ও এর ফলাফল আসলে এই তিন পক্ষকেই জিতিয়ে দিয়েছে। এই নির্বাচনে তবে হারল কে?
কুমিল্লায় যেদিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন হলো, সেই একই দিন জাতীয় সংসদের দিরাই-শাল্লা আসনের উপনির্বাচন হয়েছে। নির্বাচন হিসেবে সাধারণভাবে জাতীয় সংসদের যেকোনো আসনের নির্বাচন সিটি করপোরেশনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা দেখলাম, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তাপ ও আওয়াজ এতটাই বেশি ছিল যে জাতীয় সংসদের উপনির্বাচন তার কাছে প্রায় হারিয়েই গেছে। কারণটা আমরা জানি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া নির্বাচন জমে না। গ্রহণযোগ্যতাও পায় না। কুমিল্লার নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে, যেমন হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন।
স্থানীয় সরকার পর্যায়ের এ দুটি নির্বাচনে প্রার্থীর বিজয়ের দিকটি বিবেচনায় নিলে ফলাফল ১-১। কিন্তু জাতীয় রাজনীতির খেলায় ফলাফল ২-০। কারণ, কুমিল্লা নির্বাচনে আসল জয় পেয়েছে সরকার, সরকারি দল ও নতুন নির্বাচন কমিশন। নারায়ণগঞ্জ বা কুমিল্লার নির্বাচন দুটি বিএনপির জন্য কোনো রাজনৈতিক জয় এনে দেয়নি। বরং তাদের ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের’ দাবি এতে আরও হালকাই হচ্ছে। কুমিল্লা নির্বাচনের সামগ্রিক ফলাফলকে তাই দল হিসেবে বিএনপির ধারাবাহিক পরাজয়ের একটি হিসেবেই বিবেচনা করতে হচ্ছে।
‘পরাজয়’ ছাড়া বিএনপির সামনে সম্ভবত আর কোনো পথ নেই। এ জন্য অনেকে দলটির নানা ভুলকে দায়ী করেন। কারও মতে, এই ভুলটি হচ্ছে ৫ জানুয়ারির নির্বচনে অংশ না নেওয়া, কারও মতে ওই নির্বচনের বর্ষপূর্তিতে নেওয়ার আগুন ও পেট্রলবোমার আন্দোলন! খালেদা জিয়া অবশ্য এখন বলছেন, নির্বচনের পর আন্দোলন থেকে সরে আসাটি ভুল ছিল। তবে আসল কথা হচ্ছে, সব মিলিয়ে দলটি এখন এমন গাড্ডায় পড়েছে যে চাল যেটাই দিক, রাজনৈতিকভাবে তাকে হারতেই হবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের যে কালো দাগ সরকার ও সরকারি দলের গায়ে লেগে আছে, তাকে কিছুটা ফিকে করতে হলে সামনের জাতীয় নির্বাচনটির গায়ে যেভাবেই হোক ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ তকমা লাগাতে হবে। আর সে জন্য ওই নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ লাগবে। তবে আওয়ামী লীগকে এ জন্য খুব কষ্ট করতে হবে বলে মনে হয় না। বিএনপি এখনো মুখে যা-ই বলুক, আওয়ামী লীগের শর্তেই তাকে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যেতে হবে। সরকারের কাছ থেকে দৃশ্যমান কোনো ‘দাবি’ আদায় বা ‘রাজপথের বিজয়’ নিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ দলটি পাবে না। তেমন কোনো পরিস্থিতও নেই, আর বিএনপির সে ক্ষমতাও নেই। অথবা বলা ভালো যে আওয়ামী লীগ তা হতে দেবে না। মানে পরাজয়ের ধারাবাহিকতার মধ্যেই বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে হবে।
কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পরাজয়ের পর দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মন্ত্রী মোহান্মদ নাসিম বলেছেন, আসল নির্বাচন হচ্ছে ২০১৯ সালের নির্বাচন। এর অর্থ হচ্ছে, এই নির্বাচনে বিএনপির বিজয় নিয়ে আওয়ামী লীগের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। কুমিল্লা নির্বাচনের পর বিএনপি তাদের ‘জনসমর্থন’ নিয়ে যতই গদগদ হোক, আওয়ামী লীগ এই বিজয়ের সঙ্গে বিএনপির জনসমর্থনের কোনো সম্পর্ক দেখতে নারাজ। নেতাদের মূল্যায়ন অনুয়ায়ী এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের কারণ তো ‘দলীয় কোন্দল’, ‘বিভক্তি’ বা ‘পারিবারিক’ সমস্যা। আগামী নির্বাচনের আগে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ এসব ‘ঝামেলা’ দূর করে ফেলবে! বিএনপি তখন কী করবে?