তৃষ্ণা মিটল না বাংলাদেশের
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর এবং ২০১৭ সালের এপ্রিল—ব্যবধানটা প্রায় ছয় বছরের। দুটো শীর্ষ বৈঠক। কিন্তু বৈঠক দুটির খবরের শিরোনাম প্রায় এক। তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান দ্রুতই করা হবে। সোজা কথায়, বাংলাদেশ এই সফর থেকে ন্যূনতম যা পাওয়ার আশা করেছিল, সেটাও ঝুলে থাকল।
টাইমস অব ইন্ডিয়া ৭ সেপ্টেম্বর ২০১১ শিরোনাম করেছিল, ‘মনমোহন সিং, শেখ হাসিনা পুট অ্যাসাইড তিস্তা বিহাইন্ড, ফিক্স বাউন্ডারি’, যার মানে হচ্ছে, মনমোহন সিং এবং শেখ হাসিনা তিস্তাকে সরিয়ে রেখে সীমান্ত ঠিক করলেন। আমরা জানি, মনমোহন সিং তিস্তা নিয়ে আলোচনা এগোনো তো দূরের কথা, রাজনৈতিক (ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপির বিরোধিতা) কারণে সীমান্ত চুক্তিও তাঁর পার্লামেন্টে অনুমোদন করাতে পারেননি। তারপর ভারতে সরকার বদল হয়েছে ২০১৪ সালে এবং ক্ষমতায় এসেছেন বিজেপির নেতা নরেন্দ্র মোদি। কংগ্রেস যদি পাল্টাপাল্টির রাজনীতি করত, তাহলে ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে সীমান্তের চূড়ান্ত রূপ দেওয়াও ভেস্তে যেত। চার দশক আগে বাংলাদেশ যে চুক্তি অনুমোদন করেছে, সেটি শেষ পর্যন্ত ২০১৫-তে ভারতীয় সংসদ অনুমোদন করল। এরপর প্রধানমন্ত্রী মোদি ঢাকায় এলেন। অনেক প্রত্যাশা তিস্তার পানি নিয়ে। কিন্তু সেবারও তা ভেস্তে গেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গেলেন সাত বছর পর। সুতরাং আবারও প্রত্যাশার পারদ চড়ল। কিন্তু গতকাল দুই শীর্ষ নেতার বৈঠক, দ্বিপক্ষীয় আনুষ্ঠানিকতা এবং সম্মত সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি মিলিয়ে ২২টি দলিল স্বাক্ষরিত হলেও তিস্তা অমীমাংসিত থেকে গেল। এবারও প্রতিশ্রুতি। গতকাল এনডিটিভি শিরোনাম করল, ‘ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ উইল ফাইন্ড আর্লি সলুশন টু তিস্তা ইস্যু, সেজ পিএম মোদি’।
এনডিটিভিকে এক দিন আগে দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী বলেছিলেন, বাংলাদেশ অন্তত একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমা চাইবে। শীর্ষ বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁর বক্তব্যে নিজেই তিস্তার প্রসঙ্গ তুলেছেন এবং বলেছেন, ‘ভূ-সীমান্তের পাশাপাশি নদীতেও আমাদের অংশীদারত্ব আছে। এসব নদী আমাদের জনগণ এবং তাঁদের জীবনযাত্রাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। যে নদীটি সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করেছে সেটি হচ্ছে তিস্তা।’ তিনি শেখ হাসিনার উদ্দেশে বলেন, ‘আমি আপনাকে এবং বাংলাদেশের জনগণকে আমাদের অঙ্গীকার ও চেষ্টার বিষয়ে আশ্বস্ত করছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমার সরকার এবং মাননীয় শেখ হাসিনা আপনার সরকার তিস্তার পানি ভাগাভাগির বিষয়ে শিগগিরই একটি সমাধান খুঁজে পেতে পারি এবং পারব।’ এর আগে অবশ্য ভারতীয় বিশ্লেষকেরা আভাস দিয়েছিলেন যে গঙ্গা অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা এবং গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণে বাংলাদেশকে ভারত সহায়তা দেবে। শীর্ষ বৈঠকের পর শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা তিস্তা, পদ্মা-গঙ্গা ব্যারাজ এবং অববাহিকার অভিন্ন নদীগুলোসহ পানি ভাগাভাগি এবং সামগ্রিক পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আলোচনা করেছি। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি, আমরা দ্রুততার সঙ্গে এসব সমস্যা সমাধানে ভারতের সহায়তা পাব।’ অনলাইন সংবাদ পোর্টাল ওয়্যার জানিয়েছে, ভারতীয় অধিকর্তারা বৈঠকে জানিয়েছেন যে গঙ্গা ব্যারাজ প্রশ্নেও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের সংযুক্তি থাকার ফলে তিস্তার মতো ওই প্রকল্পও একই ধরনের বাধার মুখে পড়বে।
ভারতীয় কূটনীতিক ও বিশ্লেষকেরা সবাই প্রায় একবাক্যে বলছেন যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারই হচ্ছে তিস্তা চুক্তির পথে অন্তরায়। তাঁরা সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বিজেপির সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূলের রাজনৈতিক দূরত্ব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে বলে মন্তব্য করেছেন। এর আগে, মনমোহন সিংয়ের সময়ও কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক দূরত্ব ছিল। স্পষ্টতই ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ বাংলাদেশের পানির পিপাসাকে দীর্ঘায়িত করছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা সরকার আগেও যেমনটি বলেছেন, এবারও ঠিক একই কথা বলেছেন। তাঁর কথায়, ‘আগে রাজ্যের স্বার্থ, তারপর অন্যকিছু।’ প্রচণ্ড চাপের মুখে এবার তিনি বাড়তি যে কথাটি যুক্ত করেছেন তা হলো ‘তিস্তায় তো জল নেই’। প্রধানমন্ত্রী মোদি যতই আমাদের আশ্বস্ত করুন না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে রাজ্যকে আস্থায় নিয়ে তাঁর পক্ষে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্ভব হবে—এমনটি বিশ্বাস করা কঠিন। বস্তুত ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জটিল সমীকরণে ছিটমহল বিনিময়ে চার দশক লাগার দৃষ্টান্তের কারণে ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়।
ভারত, বাংলাদেশ এবং বাইরেও কূটনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা প্রায় কোরাসের সুরে এখন বলে থাকেন যে দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যকার সম্পর্ক এখন সবচেয়ে ভালো। বাণিজ্য বাড়ছে, সাংস্কৃতিক বিনিময় বাড়ছে। চিকিৎসা ও শিক্ষার মতো সেবা খাত এবং পর্যটনে ভারত বিপুল সংখ্যায় বাংলাদেশিদের আকৃষ্ট করছে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের পণ্য পরিবহন-সুবিধা বাস্তবায়িত হয়েছে। সর্বোপরি, নিরাপত্তা প্রশ্নে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে যতটা সহযোগিতা পেয়েছে, তাতে তাদের সন্তোষের কথা তারা প্রকাশ্যেই জানিয়েছে। বিশেষ করে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে দমনের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সরকার যে সহযোগিতা দিয়েছে, তা সবার কাছে প্রশংসিত হয়েছে।
এই নিরাপত্তা সহযোগিতাকে আরও সুদৃঢ় ও সংহত করাই এখন ভারতের প্রধান লক্ষ্য। সেই উদ্দেশ্যে ভারত নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়গুলোকে যে আনুষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে আগ্রহী হবে, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। ভারতীয় বিশ্লেষকেরা সাম্প্রতিক জঙ্গি-সন্ত্রাসী তৎপরতাকে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য উদ্বেগের কারণ হিসেবেও অভিহিত করেছেন। যদিও ভারতে সংঘটিত জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার সিংহভাগই ঘটিয়েছে পাকিস্তানকেন্দ্রিক গোষ্ঠীগুলো অথবা ভারতের অভ্যন্তরীণ জঙ্গিরা। বাংলাদেশ থেকে কিছু জঙ্গির বিভিন্ন সময়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার কথা বিভিন্ন সূত্রে বলা হলেও সরকারিভাবে এ বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
উভয় দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা, বিশেষ করে সফরবিনিময়, প্রশিক্ষণ ও যৌথ মহড়া এর আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে শুরু হয়। সময়ের পরিক্রমায় সেই সহযোগিতা যথেষ্ট বেড়েছে। এখন সেগুলোকে আনুষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার জন্য স্বাক্ষরিত হয়েছে পাঁচ বছর মেয়াদি সমঝোতা স্মারক বা এমওইউ। প্রথমে শোনা গিয়েছিল ২৫ বছর মেয়াদি প্রতিরক্ষা চুক্তির কথা। বাংলাদেশে সরকারিভাবে এ বিষয়ে কিছু প্রকাশ না করা হলেও ভারতের সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে ঢের আলোচনা লক্ষ করা গেছে। চীন থেকে বাংলাদেশ দুটি সাবমেরিন কেনায় ভারতীয় বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বাংলাদেশকে চীনের অক্ষিবলয়ের বাইরে রাখার তাগিদ অনুভবের কথা জানান। গত বছর বিশ্বের সর্বোচ্চ অস্ত্র আমদানিকারক দেশ হওয়ার পরও বাংলাদেশে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির জন্য ভারতের ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে তাই নানা গুঞ্জন ওঠে। তবে ভারতীয় কূটনীতিকেরা বলেন যে বাংলাদেশে যৌথভাবে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনই হচ্ছে ওই ঋণ প্রস্তাবের লক্ষ্য।
গতকাল প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতার তিনটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। সেগুলো সম্পর্কে কতটা তথ্য প্রকাশ করা হবে এবং তার প্রতিক্রিয়ার প্রতি নজর থাকবে সবারই। সব মিলিয়ে যে ২২টি ক্ষেত্রে সহযোগিতার সমঝোতা বা চুক্তি সই হলো, তাতে উভয় দেশের সম্পর্কে ইতিবাচক অনেক পরিবর্তনই আসবে। কিন্তু পানি না পাওয়ার তৃষ্ণা ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠলে স্বস্তি ফিরবে না।