মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: ১৮ বছর আগে যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের শুরু করেছিল হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী-বাংলাদেশ (হুজি-বি)। এরপরের ছয় বছরে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাসহ অন্তত ১৬টি ভয়ংকর বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালায় এই জঙ্গি সংগঠন। এসব হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী ছিলেন মুফতি আবদুল হান্নান। গতকাল বুধবার তাঁর ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে দেশে জঙ্গিবাদের একটি অধ্যায়ের অবসান ঘটল।

সিলেটে ২০০৪ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা ও তিনজন নিহত হওয়ার মামলায় গতকাল মুফতি হান্নান ও তাঁর দুই সহযোগীর ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে। রাত ১০টায় গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে মুফতি হান্নান ও হুজি-বির সদস্য শরীফ শাহেদুল আলম বিপুলের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। আরেক হুজি সদস্য দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসি একই সময়ে কার্যকর হয়সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে। কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক মো. মিজানুর রহমান বলেন, রাত ১০টায়একসঙ্গে মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুলের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক একই সময়ে মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

রাত ১২টার দিকে পুলিশ পাহারায় মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুলের লাশ তাঁদের গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়। হান্নানের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার হিরন গ্রামে ও শাহেদুলের বাড়ি চাঁদপুর জেলায়। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে দেলোয়ারের লাশ রাত ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে তাঁর গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কুলগাঁওয়ে পাঠানো হয়।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘হান্নানদের যুগ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখনকার জঙ্গিদের সঙ্গে হান্নানদের অনেক ফারাক। হান্নান ধরা পড়ার পর দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া শেষে তিনি ফাঁসির দণ্ড পেয়েছেন। তারপর তিনি প্রাণভিক্ষার আবেদনও করেছেন। কিন্তু এখনকার জঙ্গিরা এসবের ঊর্ধ্বে। তারা সুইসাইড ভেস্ট পরে চলাফেরা করছে। তবু বলা যায়, হান্নানরা যে রক্তাক্ত একটা অধ্যায়ের শুরু করেছিল, তার সমাপ্তি ঘটছে হান্নানের ফাঁসির মধ্য দিয়ে।’

বাংলাদেশে এর আগে ঝালকাঠিতে দুই বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ে ও সোহেল আহমেদ হত্যা মামলায় নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সাত সদস্যের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এর মধ্যে ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ ছয় জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তাঁরা হলেন জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, শায়খ রহমানের ভাই আতাউর রহমান সানি, জামাতা আবদুল আউয়াল, ইফতেখার হোসেন মামুন ও খালেদ সাইফুল্লাহ ওরফে ফারুক। ওই সময় পলাতক মামলার অপর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আসাদুল ইসলাম ওরফে আরিফের ফাঁসি কার্যকর হয় গত বছরের ১৬ অক্টোবর খুলনা কারাগারে।

নিরাপত্তায় মোড়া কাশিমপুর

গত ৬ মার্চ মুফতি হান্নানসহ রমনা বটমূলে বোমা হামলার আসামিদের ঢাকার আদালত থেকে কাশিমপুরে নিয়ে যাওয়ার সময় টঙ্গীতে তাঁদের বহনকারী প্রিজন ভ্যানে বোমা হামলা হয়। পুলিশ এ সময় এক তরুণকে ধরে ফেলে। এরপর দেশের কারাগারগুলোতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। গতকাল মুফতি হান্নানসহ দুজনের ফাঁসিকে কেন্দ্র করে কাশিমপুর কারাগারসহ আশপাশের এলাকার নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। দুপুরের পর ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের নতুন বাজার মোড় থেকে কাশিমপুর কারাগারের প্রধান ফটক পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারাগারের প্রধান ফটকের দুপাশের দেড় শতাধিক দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়।

রাত সাড়ে নয়টার দিকে কারা ফটকে গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, ফাঁসি কার্যকরের পর জঙ্গিদের লাশ পাহারা দিয়ে পৌঁছে দেবে গাজীপুর জেলা পুলিশ।

স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ

নিয়ম অনুযায়ী মুফতি হান্নানের সঙ্গে গতকাল শেষ দেখা করেন স্বজনেরা। গত মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে পরিবারের চার সদস্য গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থানার হিরন গ্রাম থেকে রওনা দিয়ে গতকাল সকালে কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছান। সকাল সাতটার দিকে চার স্বজন কারাগারে হান্নানের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা হলেন হান্নানের স্ত্রী জাকিয়া পারভিন, বড় মেয়ে নিশি খানম, ছোট মেয়ে নাজরিন খানম ও বড় ভাই আলিউজ্জামান মুন্সি। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া হান্নানের দুই ভাই বেলা দুইটার দিকে হান্নানের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা হলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে থাকা মহিবুল ইসলাম ও কাশিমপুর কারাগারে থাকা মো. আনিস।

সকালে সাক্ষাৎ শেষে হান্নানের ভাই আলিউজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, হান্নান মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন। তিনি ভাইকে তাঁর (হান্নানের) সন্তানদের প্রতি লক্ষ রাখতে অনুরোধ করেছেন। সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে বলেছেন।

রাতে কারা কর্তৃপক্ষ তাঁর মায়ের ফোনে কল করে হান্নানের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়। মা রাবেয়া বেগম মুঠোফোনে বলেন, সাড়ে আটটার দিকে কারা কর্তৃপক্ষ ফোন করে কথা বলিয়ে দেয়। দুই মিনিটের মতো কথা হয়।

গ্রেপ্তার ও ভিন্ন খাতে তদন্ত

২০০৫ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডার বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন মুফতি হান্নান। এরপর বিভিন্ন মামলায় টানা ১২০ দিন রিমান্ডে ছিলেন তিনি। তখনই গোয়েন্দা সংস্থার কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে গ্রেনেড হামলাসহ বিভিন্ন হামলায় জড়িত থাকার বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ দেন। কিন্তু তৎকালীন সরকার তা প্রকাশ করেনি।

বরং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করে। গোয়েন্দাদের কাছে দেওয়া হান্নানের ওই জবানবন্দি প্রথম ২০০৭ সালের ২১ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ বিভিন্ন মামলা নতুন করে তদন্তের উদ্যোগ নেয়।

মামলা

দেখা গেছে, হুজি-বির জঙ্গিরা দেশে ছয় বছরে অন্তত ১৬টি নাশকতামূলক ঘটনা ঘটায়। এসব ঘটনায় নিহত হন ১১১ জন, আহত হন ৬০৯ জন। এসব হামলা ও হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন মুফতি হান্নান। এসব ঘটনায় হান্নানের বিরুদ্ধে ৩৫টি মামলা হয়। এর মধ্যে গোপালগঞ্জে বোমা পুঁতে রাখার মামলায় তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। রমনা বটমূলে বোমা হামলা, সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর হামলার মামলায় তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়। বাকি মামলাগুলো তদন্ত ও বিচারাধীন।

যেভাবে ফাঁসির মঞ্চে

২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটে হজরত শাহজালাল (রা.)-এর মাজারের ফটকে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা হয়। এতে পুলিশের দুজন কর্মকর্তাসহ তিনজন নিহত এবং আনোয়ার চৌধুরীসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। ২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল এই মামলায় মুফতি হান্নান, শরীফ শাহেদুল ও দেলোয়ারকে মৃত্যুদণ্ড দেন। হাইকোর্ট ও সর্বোচ্চ আদালতে হান্নানসহ তিনজনের ফাঁসির দণ্ড বহাল থাকে। তাঁদের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনও খারিজ হয়। তাঁরা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করলে সেটিও নাকচ হয় বলে গত রোববার জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচের কপি কারাগারে পৌঁছানোর পর কারাবিধি অনুযায়ী ফাঁসির প্রস্তুতি শুরু করে কারা কর্তৃপক্ষ।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ