জিয়া-যাদু গোপন চুক্তিটা কি প্রকাশ করবেন খালেদা জিয়া ?

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াই সম্ভবত ইতিহাসের প্রথম সরকারপ্রধানের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ, যিনি স্বীকার করলেন, ‘প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা এককভাবে প্রধানমন্ত্রীর ওপর ন্যস্ত। এরূপ ব্যবস্থা সংসদীয় সরকারপদ্ধতির স্বীকৃত রীতির পরিপন্থী।’ সে জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু তাঁর এই উপলব্ধি কতটা গণতন্ত্রমনস্ক অনুভূতিপ্রসূত, সেটা কোটি টাকা দামের প্রশ্ন। তিনি সংবিধানের সবচেয়ে বিতর্কিত ৭০ অনুচ্ছেদ, যা পার্লামেন্টকে একটি রাবার স্ট্যাম্প এবং প্রধানমন্ত্রী বা সংসদ নেত্রীর বশংবদ করে রেখেছে, সে বিষয়ে তিনি একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।

ওয়েস্টিনের জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া অবশ্য বলেছেন, ‘বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোর অভিজ্ঞতায় দেশবাসী গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে যে প্রধানমন্ত্রীর একক নির্বাহী ক্ষমতা সংসদীয় সরকারের আবরণে একটি স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক শাসনের জন্ম দিয়েছে। এরূপ অবস্থার অবসানকল্পে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনা হবে।’

বেগম খালেদা জিয়ার ওই মন্তব্য আমাকে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে জিয়া মন্ত্রিসভার সিনিয়র মিনিস্টার মশিউর রহমান যাদু মিয়ার সম্পাদিত একটি গোপন চুক্তিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। ক্যান্টনমেন্টে বসে জিয়া যে রাজনৈতিক দল করেছিলেন, তার অন্যতম প্রধান বেসামরিক স্থপতি ছিলেন যাদু মিয়া। যাদু মিয়ার গোপন চুক্তিটি কেন আজও গোপনীয়, তার ব্যাখ্যা বিএনপিকে দিতে হবে এবং সেটা আমরা বিএনপিকে বিব্রত করতে নয়, বরং তাদের আত্মজিজ্ঞাসার স্বার্থে এটা দরকারি। কারণ, যাদু মিয়া জিয়াকে বলেছিলেন, আমি আপনাকে সামরিক লেবাস খুলে বেসামরিক লেবাস পরাতে পারি। কিন্তু আপনাকে ক্ষমতার ভারসাম্য আনাতে হবে। যাদু মিয়া দেখেছিলেন, জেনারেল জিয়া উর্দি খুলে প্রেসিডেন্ট হতে ভরসা পাচ্ছেন না। জিয়া মনে করতেন, চতুর্থ সংশোধনী রাষ্ট্রপতিকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। আরও ক্ষমতা কুক্ষিগত করা দরকার। তখন যাদু মিয়া বলেছিলেন, এটা মানা যাবে না। এক ব্যক্তির হাতে এত ক্ষমতা থাকা ঠিক নয়। আপনাকে ভারসাম্য আনতে হবে। কুশলী জিয়া রাজি হলেন। যাদু মিয়া চুক্তি করিয়ে নিলেন। মওদুদ আহমেদকে বুধবার যথারীতি বেগম খালেদা জিয়ার পাশে দেখা গেছে। তিনি আমার কাছে এই গোপন চুক্তির কথা স্বীকার করেছেন। বলেছেন, তিনি নিজেও যাদু মিয়ার পক্ষে ছিলেন না। তিনি জিয়ার পক্ষ অবলম্বন করেন। কারণ, সেদিনের বাস্তবতায় এর দরকার ছিল। কিন্তু সেই ‘বাস্তবতা’ কখন, কবে এ দেশ থেকে গিয়েছে এবং বিএনপি সেটা স্বীকার করেছে, সেটা আমাদের জানা নেই।

বেগম খালেদা জিয়াবিএনপির গঠনতন্ত্রে সব ক্ষমতা বাংলাদেশ সংবিধানের থেকেও খারাপভাবে চেয়ারপারসনের হাতে কুক্ষিগত আছে। যেভাবে বিধানাবলি লেখা আছে, সেটা স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের একটি নিকৃষ্ট উদাহরণ। এখন বিএনপি আমাদের বলবে, তারা ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধান সংশোধন করবে, আর এখন তারা এ বিষয়ে নীরব থাকবে, সেটা তো যুক্তি হতে পারে না। প্রমাণ দেখাতে চাইলে তাদের আগে দলের সংবিধান শোধরাতে হবে। আমার বিশ্বাস, ক্ষমতাসীন দল তাদের ওপর যত অন্যায্য আচরণই করুক, এই কাজ সারতে বাধা দেবে না। এ কথা বলছি এ কারণে যে বিএনপির নেতারা বলবেন, এটা একটা রাজনৈতিক বাস্তবতা, সে কারণে তারা ওখানে হাত দিচ্ছেন না। যদি সেটাই হবে, তাহলে যা দলের সংবিধানে করা যাবে না, সেটা কেন ও কী কারণে দেশের সংবিধানে করা যাবে।

আর যাদু মিয়ার গোপন চুক্তির কপি কি সত্যিই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে? এটি ভালো-মন্দ যা-ই হোক, আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক ইতিহাসে এর অসামান্য মূল্য রয়েছে। আমি জিয়া-যাদু গোপন চুক্তিটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। ওটা কারও মতে হতেই পারে ষড়যন্ত্রমূলক। তবু আমি বলব, এটা একটা রাজনৈতিক সন্ধিপত্র। যার মূল কথাই ছিল, দেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংস্কার করা। জিয়া-যাদু সম্পর্ক এবং সেখানে যে একটি ট্র্যাজেডি আছে, সেটা আমরা বিস্মৃত হতে পারি না। যাদু মিয়ার ভাই মেখলেসুর রহমানের (সিধু ভাই) একটি অসামান্য সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সরদার ফজলুল করিম ও মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। এটি প্রতিচিন্তার ওয়েব ঠিকানায় গত ১৭ এপ্রিল আপলোড করা হয়েছে। সিধু ভাইয়ের কথায় ইঙ্গিত আছে, জিয়া যাদু মিয়ার সঙ্গে কথা রাখেননি। তাঁর স্ট্রোক হওয়ার পরে সরকারি চিকিৎসকেরা দরকারি ইনজেকশন তাঁর শরীরে পুশ করেননি!

লক্ষ করেছি, আওয়ামী লীগ নেতারা খালেদা জিয়ার ভিশন ২০৩০-এর সমালোচনা করতে গিয়ে প্রধানত যুক্তি দিচ্ছেন, এটা তাঁদের রূপকল্প ২০২১-এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। আর এটা রাজনৈতিক ভাঁওতাবাজি। এ রকম প্রতিক্রিয়া নির্দেশ করছে যে বাংলাদেশে উন্নয়ন চলছে, কিন্তু রাজনৈতিক কোনো গুণগত পরিবর্তন নেই। কোনো রাজনৈতিক উন্নয়ন নেই। অবশ্য সার্বিকভাবে বিএনপি নেত্রী যেভাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন, যেভাবে কথা বলেছেন, তাতেও যে মৌলিকভাবে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ইঙ্গিত আছে, তা বলা যাবে না।

শুধু ওবায়দুল কাদেরের বরাতে একটি নির্দিষ্ট মন্তব্য মিডিয়ায় এসেছে। তিনি ইউনিটারি চরিত্রের রাষ্ট্রব্যবস্থায় কী করে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভব, সেই প্রশ্ন তুলেছেন। জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৬৫টিই চলছে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হিসেবে। এর মধ্যে ব্রিটেন হলো অন্যতম উদাহরণ, যারা দেশটিকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো অঙ্গরাজ্যে বিভক্ত করেনি। স্কটল্যান্ড, ওয়েলস, নর্দান আয়ারল্যান্ডকে কতিপয় স্বায়ত্তশাসন বা ডেভেলপড পাওয়ার দেওয়া হয়েছে। অথচ তাদের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা বহাল রয়েছে। বরং ব্রিটিশ গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য, যা আমরা অনুকরণ করে চলছি বলে দাবি করে থাকি, তাদের সেই ঐতিহ্য মূলত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা থেকেই উৎসারিত। আমরা সেই ১৯৭২ সালেই খণ্ডিতভাবে না নিয়ে ব্রিটেনকে উপযুক্তরূপে অনুসরণের চেষ্টা করা উচিত ছিল বলেই প্রতীয়মান হয়। তবে এটাও বলতে হবে, বেগম খালেদা জিয়া ‘সংসদীয় ব্যবস্থা সংস্কারের অংশ’ হিসেবে সংসদে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ করে দেখার কথাই শুধু বলেছেন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কোন ধারণা থেকে তিনি এই প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটা বিশ্বাস করা কঠিন। সে বিশ্বাস করাতে চাইলে তাঁকে আরও অনেক কিছুই পরিষ্কার করতে হবে। ওয়েলসের মতো প্রশাসনিক ইউনিটগুলো আলাদা আইন করতে পারে। পার্লামেন্ট তাদের সেটা করার ক্ষমতা ডেলিগেট করেছে। স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করার প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া পাঁচটি প্যারাগ্রাফ ব্যয় করলেও সেখানে উচ্চকক্ষ করার কোনো যোগসূত্র রাখেননি। সুতরাং, প্রতীয়মান হয় এটা একটা অপরিণামদর্শী চমকপ্রসূত রাজনৈতিক অঙ্গীকার। এই দল সাত বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। তাদের জনসভা করার কাজেও সময় ব্যয় করতে হয়নি। অথচ উচ্চকক্ষ কেমন ও কী হবে, তার ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ করার জন্য তাদের জনগণের ক্ষমতায় বসাতে হবে। এটা পরিহাসমূলক যে তাদের সবধরণের সংস্কার প্রস্তাবই বাস্তবায়ন হতে হবে শুধু তাদের হাতেই । তারা ‘যদি’ ক্ষমতায় যায়, তখন ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজনের অবসান’ ঘটিয়ে তবেই তারা যেন এসব বিষয় জাতিকে উপহার দেবে!

১৯৯৪ সালে আমার লেখা একটি বইয়ের একটি পরিচ্ছেদের শিরোনাম হলো ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা : একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা’। এতে আমি দেখিয়েছে, সংসদীয় গণতন্ত্র অনুশীলনরত কোনো দেশে বাংলাদেশি মডেলে এভাবে ব্যক্তির হাতে নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করেই প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা ব্যক্তির হাতে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনী করার সময় বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা একমত হয়েছিলেন, ব্যক্তির হাতেই নির্বাহী ক্ষমতা থাকবে। সুতরাং, কবে থেকে আমরা উপলব্ধি করলাম যে এটা গণতন্ত্রায়ণের পথে বাধা, সেটা পরিষ্কার হওয়া দরকার।

এত দিনে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি, রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপস্থিতি ব্যতিরেকে কোনো ধরনের সাংবিধানিক সংস্কার করা হলেও তা থেকে সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। আমরা রাষ্ট্রপতি-শাসিত কিংবা সংসদীয় নামকরণ যা-ই করেছি, দেশে সাংবিধানিক স্বৈরশাসনকে সবাই মিলে নিরাপত্তা বিধান ও সুরক্ষা দিয়ে চলছি। তবে কথা হলো জিয়া-যাদু চুক্তির বিষয়ে বিএনপিকে মুখ খোলার এখনই সময় বলে মনে করি। এটা বিএনপির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের স্বার্থেও অপরিহার্য। নীরবতা দিয়ে ইতিহাস ঢাকা যাবে না।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ