কে বলে পুলিশ পারে না তারাও পারে
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: বাংলাদেশের পুলিশ অপরাধীদের ধরতে অক্ষম, এ অভিযোগ মোটেই সত্য নয়। তারা যেমন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভয়ংকর জঙ্গিকে পাকড়াও করতে পারে, তেমনি ধরতে পারে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ক্ষমতাবান পলাতক আসামিকেও—যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। পুলিশ তার পেশাগত দায়িত্ব ও কর্তব্যনিষ্ঠার আরেকটি প্রমাণ দিল বনানীর ‘দ্য রেইনট্রি’ হোটেলে সংঘটিত ঘৃণ্য ও পৈশাচিক ঘটনার দুই হোতাকে গ্রেপ্তার করে।
গত ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর ‘দ্য রেইনট্রি’ হোটেলে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের নাম করে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়।
এটি কী করে সম্ভব? মানুষ কী করে এতটা অমানুষ হতে পারে? কী করে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের নাম করে দুই মেয়ে বন্ধুকে হোটেলে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করতে পারে তাঁদের কথিত ছেলে বন্ধু? কী করে নিজের গাড়িচালককে দিয়ে ধর্ষণের সেই বীভৎস ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওচিত্র প্রকাশের হুমকি দিতে পারে ভদ্রবেশী নরপশু?
বনানীর এই ঘটনা আমাদের সমাজ ও সভ্যতাকে আবারও আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিল। তা হলে আমরা যে নিজেদের সভ্য বলে দাবি করি, তা কি শুধুই ফাঁপা বুলি? এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা এত ক্ষীণ কেন? কেন জাগ্রত হচ্ছে না মনুষ্যত্ববোধ?
পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-গোপনীয়) মো. মনিরুজ্জামান জানান, সিলেটের জালালাবাদের একটি বাড়িতে শাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফ লুকিয়ে ছিলেন। রাত নয়টায় পুলিশ সদর দপ্তরের একটি দল তাঁদের গ্রেপ্তার করে। এরপর শাফাত ও সাদমানকে ঢাকায় আনা হয়। এর আগে ওই দুই আসামি একটি হোটেলের কক্ষ ভাড়া নিতে গেলে কর্তৃপক্ষ তাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেখতে চায়। কিন্তু তাঁরা সেটি দেখাতে পারায় তাঁদের ভাড়া দেওয়া হয়নি। দুই হোটেল কর্তৃপক্ষের মধ্যে কত ফারাক। ঢাকার রেইনট্রি হোটেল কর্তৃপক্ষ সেখানে নির্বিঘ্নে অপরাধ ঘটতে দিয়েছে। আর সিলেটের হোটেল কর্তৃপক্ষ অপরাধীদের আশ্রয় দেয়নি। তারা ধন্যবাদ পেতে পারে।
ঘটনার ৪০ দিন পর ভুক্তভোগী ওই দুই ছাত্রী ৬ মে সন্ধ্যায় বনানী থানায় ধর্ষণের অভিযোগে পাঁচজনকে আসামি করে একটি মামলা করলে চারদিকে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় প্রথমে থানা-পুলিশ মামলা নিতে অস্বীকার করে, পরে মামলা নিতে বাধ্য হয়।
প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর ‘দ্য রেইনট্রি’ হোটেলে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে নেওয়া হয়। শাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও দেহরক্ষী তাঁদের বনানীর ২৭ নম্বর রোডের দ্য রেইনট্রি হোটেলে নিয়ে যান। এ সময় তাঁদের সঙ্গে শাহরিয়ার নামের এক বন্ধু ছিলেন। তাঁদের বলা হয়েছিল, এটা একটা বড় অনুষ্ঠান, অনেক লোকজন থাকবে। হোটেলে যাওয়ার পর সাফাত ও নাঈমের সঙ্গে তাঁরা আরও দুই তরুণীকে দেখেন। পরিবেশ ভালো না লাগায় শাহরিয়ারসহ দুই তরুণী চলে আসতে চেয়েছিলেন। তখন আসামিরা শাহরিয়ারের কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে নেন এবং শাহরিয়ারকে মারধর করেন। এরপর দুই তরুণীকে অস্ত্রের মুখে একটি কক্ষে নিয়ে যান। ধর্ষণ করার সময় শাফাত গাড়িচালককে ভিডিও চিত্র ধারণ করতে বলেন। আর নাঈম আশরাফ মারধর করেন।
এজাহার সূত্রে জানা যায়, মামলার এক আসামি শাফাত আহমেদ, যাঁর বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ। অন্য আসামিরা হলেন নাঈম আশরাফ, সাদমান সাকিফ, শাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও তাঁর দেহরক্ষী আবুল কালাম আজাদ। বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর হাকিম নুরুন্নাহার ইয়াসমিন তাঁর খাসকামরায় বেলা একটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ওই দুই শিক্ষার্থীর জবানবন্দি গ্রহণ করেন।
পুলিশের যে ইউনিট ও সদস্যরা আসামিদের গ্রেপ্তার করেছেন, আমরা তাঁদের অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই। একই সঙ্গে এ কথাও বলব, গণমাধ্যমে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার যেসব বক্তব্য এসেছে, সেগুলো সত্য হলে তাঁর পুলিশ বিভাগে চাকরি করার অধিকার নেই। তিনি অপরাধীদের বাঁচাতে উল্টো অভিযোগ দায়েরকারী দুই নারীকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে অপমান করেছেন। এই প্রসঙ্গে আমরা সিলেটে রাজন হত্যার এক আসামিকে ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা স্মরণ করতে পারি। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তাঁকে বিমানবন্দর দিয়ে পার করে দিয়েছিলেন পুলিশের এক কর্মকর্তা। পরে অবশ্য সেই আসামিকে সৌদি আরব থেকে ফিরিয়ে এনে বিচারে সোপর্দ করা হয়।
আর ধর্ষণ মামলায় এক আসামির বাবা যা বলেছেন, সেটি কেবল ঘটনা ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়া নয়, অপরাধী পুত্র ও তাঁর সহযোগীদের রক্ষার অপপ্রয়াসও বটে। ওই পিতাকে বলব, তিনিও তো মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়েছেন। এ রকম ঘৃণ্য ঘটনা যদি তাঁর কন্যার ক্ষেত্রে ঘটত তিনি কী অপরাধীকে রক্ষা করতেন?
একটি সাধারণ অভিযোগ আছে, আইন এবং আইনের রক্ষক পুলিশ ক্ষমতার প্রতি প্রায় অন্ধ থাকে। বনানীর ঘটনায় পুলিশ সেটি করবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। অভিযুক্তরা বিত্তবান ও ক্ষমতাধর হওয়া সত্ত্বেও তারা দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ মন্দ কাজ করলে যদি আমরা নিন্দা করি, ভালো কাজ করলে প্রশংসা করব না কেন?
একাত্তরে স্বাধীনতার সূচনা প্রহরে যে পুলিশ বাহিনীর যাত্রা শুরু হয়েছিল বিদ্রোহ আর প্রাণদানের মধ্য দিয়ে সেই পুলিশ অপরাধ কিংবা অপরাধীর সঙ্গে আপস করতে পারে না।