বিচার বিভাগে আস্থা এখন বেশি: প্রধান বিচারপতি

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা:  অন্তরায় নিয়ে কাজ করলেও বিচার বিভাগের উপর জনগণের আস্থা এখনই বেশি বলে দাবি করেছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।

তিনি বলেছেন, বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা এখন ৯০ ভাগের উপরে। বাংলাদেশের যে কোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বিচার বিভাগ শতগুণ ভালো।

বুধবার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনের আপিলের ষষ্ঠ দিনের শুনানিতে আগের দিনের মতোই অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সঙ্গে বাহাসের এক পর্যায়ে একথা বলেন বিচারপতি সিনহা।

এদিনের শুনানিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনের পক্ষে যুক্তি দেখান অ্যাটর্নি জেনারেল, যে সংশোধনী হাই কোর্ট বাতিল করার পর আপিল বিভাগে এখন এই শুনানি চলছে।

শুনানিতে মাহবুবে আলম বলেন, ১৯৭২ সালের আদি সংবিধানে ফিরে যেতেই ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছে। এটি (সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান) সাংবিধানিক ইতিহাসে লজ্জা। সামরিক আইন জারির মাধ্যমে যতখানি হয়েছে ততখানি বাদ দিতে চাই।

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিলুপ্ত করে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংবিধানে আনার পর তা গত বছর হাই কোর্ট বাতিল করে।

মঙ্গলবারের শুনানিতে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছিলেন, বিচারক অপসারণের কোনো আইন এখন বলবৎ না থাকায় এখন নিয়োগকর্তা রাষ্ট্রপতির হাতে সেই ক্ষমতা।

বুধবারের শুনানির শুরুতেই প্রধান বিচারপতি আগের দিনের শুনানির ধারাবাহিকতায় অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেন, “বিচারক অপসারণে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার বিষয়ে সংবিধানের বাইরে গিয়ে যদি ব্যাখ্যা করেন, সেটা হবে কষ্টদায়ক।

“আপনি ইংল্যান্ডের অনেক উদাহরণ দিয়েছেন। পৃথিবীর একমাত্র সভ্য দেশ ইংল্যান্ড। যে দেশে অলিখিত সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচন, ক্ষমতা হস্তান্তর হয়ে থাকে। চুল পরিমাণ এদিক-সেদিক হয় না। ব্রেক্সিটে হেরে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের কী চিন্তা-চেতনা, মানসিকতা!”

তখন অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “আপনার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি। ইংল্যান্ডকে সভ্য দেশ বলতে পারেন না। কারণ তাদের ইতিহাসই তো লুণ্ঠনের। অন্যদের লুণ্ঠন করে নাগরিকদের সুরক্ষা দিয়েছে।”

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, “ইংল্যান্ড লুণ্ঠন করেছে, আমেরিকা করে যাচ্ছে। আমি সভ্য দেশ বলতে বুঝিয়েছি গণতন্ত্র, আইনের শাসন, নাগরিকের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে দৃষ্টিকোণ থেকে। ওরা নাগরিকদের নিরাপত্তা দিয়েছে।।”

শুনানির এক পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ আদালতে কী হচ্ছে? একটা গণশুনানি দরকার। বিচার প্রার্থীদের নিয়ে। তাদের জিজ্ঞাস করুন এখানে কী হচ্ছে?

এসময় আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে প্রধান বিচারপতির কাছে দিতে পারতেন। এখন পর্যন্ত কি কোনো অভিযোগ দিয়েছেন?

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (ফাইল ছবি)

প্রধান বিচারপতি বলেন, “আগে কী ছিল জানি না; কিন্তু আমি বুক ফুলিয়ে বলতে পারি, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের যে আস্থা সেটা ৯০ ভাগের উপরে।

“আমি কয়েকদিন আগে বাঁশখালী চৌকি আদালতে গিয়েছিলাম। সেখানে যে সংখ্যক বিচার প্রার্থী ভিড় করেছে, তা অবাক করার মতো। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি বাংলাদেশের যে কোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বিচার বিভাগ শতগুণ ভালো।”

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “আপনার সব কথার সঙ্গে একমত পোষণ করতে পারছি না।”

প্রধান বিচারপতি বলেন, “আপনি একমত পোষণ করতে পারবেন না, এটাই স্বাভাবিক।

“এ আদালতে বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। আমি দক্ষ, যোগ্য বিচারক নিয়োগ দিতে চেয়েছিলাম; কিন্তু হলো না। গত দেড় বছরে কোনো বিচারক নিয়োগ হয়নি। আপনারা যা চাচ্ছেন, সেটি হলে তো এরকম হবেই।”

গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নিয়ে বলার এক পর্যায়ে বিচারপতি সিনহা বলেন, ভারতের বিচারক নিয়োগের কলেজিয়াম প্রথা বাতিল করে সরকার নতুন আইন করেছিল। সে আইন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দিয়েছিল। কিন্তু সেটা নিয়ে সংসদে টু শব্দটি হয়নি।

“পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট। সে দেশের সংসদ ও রাজনীতিবিদরা মাথা নিচু করে তা মেনে নিয়েছে। আমরা তো সব সময় পাকিস্তানের সমালোচনা করি; আদালতের আদেশের পর সেই দেশেই কী রকম হয়েছে, আর আমাদের দেশে কী হয় তা দেখুন।”

শুনানিতে মাহবুবে আলম বলেন, “তৎকালীন টেকনোক্র্যাটমন্ত্রী যিনি এই আদালতেরই একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের এক ধরনের সুবিধা দিতেই জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে বাদ দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনী করেছেন।”

ব্যারিস্টার শফিক আহমেদকে নিয়ে এই বক্তব্যে আপত্তি জানিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, “তিনি বারের (আইনজীবী সমিতি) নির্বাচিত দুই বারের সভাপতি। তিনি অত্যন্ত সজ্জন ও ভদ্রলোক। তার মন্ত্রিত্বকালে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে মধুর সম্পর্ক ছিল। তার সম্পর্কে এমন মন্তব্য করবেন না। সুপ্রিম কোর্টকে খাটো করবেন না।

“আর টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের নিয়ে এত কথা বলছেন! তাহলে কেন এ প্রথা রেখেছেন, কেন বাতিল করেননি? একটি শব্দ ব্যবহারের আগে বুঝে-শুনে করবেন। ইট মারলে পাটকেল খেতে হবে, এটা মনে রাখবেন।”

প্রধান বিচারপতি বলেন, যার কথা বলেছেন, তার যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠনে অবদান রয়েছে। তাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি রাজনৈতিক বিষয়। এটা প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাকে ছোটো করে দেখার সুযোগ নেই। তিনি না থাকলে এটা হত না।

তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, “এখানে আবার প্রধানমন্ত্রীকে টানছেন কেন?

২০১৪ সালে সংসদ সংবিধানে এই সংশোধন আনার পর সুপ্রিম কোর্টের ৯ আইনজীবীর করা একটি রিট আবেদনে হাই কোর্ট তা অবৈধ ঘোষণার রায় দেয়।

বুধবার আপিলের শুনানিতে রিট আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ আগের দিনের শুনানির প্রসঙ্গ ধরে বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানের ব্যাপারে অ্যাটর্নি জেনারেল ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

“এ বারের দুজন (ওইসময়ের মন্ত্রিসভার দুজন সদস্য) সদস্য বলেছেন যে একটি সদ্য স্বাধীন দেশের সংবিধান তৈরি করা হয়েছিল। তখন কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। তখন করা সংবিধানে বিচারকদের অপসারণের বিষয়টি সংসদের হাতে দেওয়া হয়েছিল।

“জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হাতে করা সংবিধান তিনি নিজেই ১৯৭৪ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তন করেছেন। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকা উচিৎ নয় সেটা বঙ্গবন্ধুরই সিদ্ধান্ত, যার নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে সেই জাতির পিতাই অভিজ্ঞতার আলোকে সংবিধান সংশোধন করেছেন। এরপর বিচারপতি অপসারণ পদ্ধতিটাই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে।”

মনজিল মোরসেদ বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীতে বিচারক অপসারণের বিষয়টি তাড়াহুড়া করার কারণেই বাদ পড়েছে বলে অ্যাটর্নি জেনারেল যে যুক্তি দিয়েছেন তা ঠিক না।

তিনি যুক্তি দেখান, পঞ্চদশ সংশোধনী করার আগে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি করা হয়েছিল। ওই কমিটি দেড় বছর ধরে সবার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। ওই সংশোধনীর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেই বক্তব্য দিয়েছেন। তখন তিনি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা বাতিলের প্রস্তাবও নাকচ করে দেন।

“এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন। বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করা যাবে না। এ থেকে প্রমাণ হয়, বুঝেশুনেই পঞ্চদশ সংশোধনীতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান যুক্ত করেনি সরকার,” বলেন মনজিল।

তাড়াহুড়ো করার যুক্তি দেখানোর মাধ্যমে অ্যাটর্নি জেনারেল জাতীয় সংসদকে খাটো করেছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

কয়েকটি ঘটনার প্রেক্ষাপটে সংসদে বিচারপতিদের নিয়ে বিভিন্ন নেতিবাচক মন্তব্যের কথা উল্লেখ করে মনজিল বলেন, “সচিবদের ডাকা, সাংসদদের জামিন না দেওয়া-এসব ধারণা থেকেই বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদে ফিরিয়ে আনার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এরপর প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়ে ষোড়শ সংশোধনী আনা হলো। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নেওয়া হল।”

অস্ট্রেলিয়া, নামিবিয়া, পাকিস্তান, বুলগেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থাকার তথ্য তুলে ধরেন তিনি।

শুনানিতে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে মনজিল মোরসেদ বলেন, এটা থাকার কারণে সংসদে জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটছে না। এই অনুচ্ছেদ থাকার কারণে সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে তাদের মতামত তুলে ধরতে পারেন না। ভয় একটাই, দলের বিরুদ্ধে মত গেলে সংসদ সদস্য পদ থাকবে না।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও মনজিল মোরসেদের শুনানি শেষ হলে শেষ আধাঘণ্টা লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন অ্যামিকাস কিউরিয়া ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম।

এই মামলায় সহায়তা নিতে চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি অ্যামিচি কিউরি হিসেবে ১২ জন আইনজীবীর নাম ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি। তাদের মতামত লিখিত আকারে জমা দিতে বলা হয়।

ব্যারিস্টার আমীরের বক্তব্য উপস্থাপন অসমাপ্ত রেখেই দিনের কার্যকাল শেষ করে আদালত। আপিল বিভাগের বৃহস্পতিবারের কার্যতালিকায়ও শুনানির জন্য রয়েছে মামলাটি।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ