প্রধান বিচারপতির দুশ্চিন্তা
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: বিচারক অপসারণের প্রশ্ন উঠলে সংসদে যদি কোনো দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকে, তাহলে এক ধরনের সঙ্কট তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।
তিনি বলেছেন, “আমরা দেশের সবচেয়ে পবিত্র আইন (সংবিধান) সংরক্ষণ করি। দেখা গেল সেখানে এমন কিছু সন্নিবেশিত হলো, যাতে শূন্যতার সৃষ্টি হল। তখন কী হবে? তখন জুডিসিয়ারি কী করবে?
“পার্লামেন্টে টু থার্ড মেজরিটি (দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা) না থাকলে ওই পরিস্থিতিতে কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠলে তখন কী হবে? আমাকে এ বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে।”
বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন অবৈধ বলে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানির এক পর্যায়ে একথা বলেন প্রধান বিচারপতি।
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে এনে ২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন হয় বর্তমান সংসদে। এর বিরুদ্ধে একদল আইনজীবী আদালতে গেলে গত বছর ওই সংশোধনী বাতিলের রায় দেয় হাই কোর্ট।
একটি আইনের অধীনে সংসদ বিচারক অপসারণের কাজটি করবে বলে জানানো হয়। ওই আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও হাই কোর্ট সংশোধনীটি বাতিল করার পর তা ঝুলে যায়।
এদিকে হাই কোর্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেওয়া ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে, যার শুনানি এখন চলছে।
রাষ্ট্র ও রিট আবেদনকারী পক্ষের বক্তব্য উপস্থাপনের পর বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগে এই মামলার সপ্তম দিনের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ অ্যামিচি কিউরিদের কথা শোনেন।
সংবিধান প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ এই মামলায় সর্বোচ্চ আদালত ১২ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে অ্যামিচি কিউরি নিয়োগ দেয়।
অ্যামিকাস কিউরিয়া ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পক্ষে অবস্থান জানিয়ে বলেন, প্রশাসনসহ অন্য সব ক্ষেত্রে অপসারণের ক্ষমতা নিজ নিজ দপ্তরের থাকলে বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবে কেন?
বিভিন্ন দেশে আইনসভার হাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা থাকার যে নজির রাষ্ট্রপক্ষ তুলে ধরেছে, তার প্রতিক্রিয়ায় অ্যামিকাস কিউরিয়া ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম বলেন, ওই সব দেশেও এখন এনিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
আরেক অ্যামিকাস কিউরিয়া অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি টি এইচ খান সংবিধানের ওই সংশোধন যে সংসদে পাস হয়েছে, তার বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন।
শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, গত কয়েকদিনের শুনানিতে যার সঙ্গে উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছিল প্রধান বিচারপতির।
এদিন শেষে আপিল বিভাগ পরবর্তী কার্যদিবস অর্থাৎআগামী রোববার পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করে।
‘সচিব-পুলিশেরটা যাচ্ছে না, বিচারপতিদেরটা কেন?’
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি রোকনউদ্দিন মাহমুদ বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
বৃহস্পতিবার তার বক্তব্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দিনের শুনানি; তার শুনানির সময়ই প্রধান বিচারপতি বিচারক অপসারণের ক্ষেত্রে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সঙ্কট নিয়ে নিজের দুশ্চিন্তার কথা বলেন।
রোকনউদ্দিন বক্তব্য উপস্থাপন শুরুর পর আরেক অ্যামিকাস কিউরিয়া টি এইচ খান তার শারীরিক সমস্যার কারণে আগে বক্তব্য দিতে চাইলে তাকে সে সুযোগ দেওয়া হয়। টি এইচ খানের পর রোকনউদ্দিন তার বক্তব্য শেষ করেন।
রোকনউদ্দিন বিচারপতিদের নিয়ে জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্যদের করা বিভিন্ন মন্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, তাদের হাতে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়।
তিনি বলেন, “তোরে জজ বানাইছে কেডা-পত্রিকায় এরকম দেখেছি। যারা সংসদে দাঁড়িয়ে এরকম কথা বলে তাদের হাতে এটা (বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা) ছেড়ে দিবেন? তখন জুডিশিয়ারির স্বাধীনতা থাকবে?
“সুপ্রিম কোর্টের জজ নিয়ে সংসদে আলোচনার সুযোগ নেই। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সদস্যরা আলোচনা করেছে। কিন্তু স্পিকার টু শব্দ করেনি।”
প্রশাসনের বিভিন্ন ব্যক্তিদের অপসারণের প্রক্রিয়া তুলে ধরে রোকনউদ্দিন বলেন, “সিভিল সার্ভিসের ব্যক্তিদের কারা অপসারণ করে? পুলিশকে কারা করে? সেক্রেটারিদের কারা করে? আপনি? সংসদ?
“কেউ না। তাদের উপরস্থরা রিমুভ করে। অর্থাৎ সহকারী সচিবদের তদন্ত করে যুগ্ম সচিবরা। পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। মিলিটারিদেরটা তাদের ডিসিপ্লিনারিতে আছে। তাহলে আপনাদেরটা কেন পার্লামেন্টে যাবে?”
সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল না থাকলে অরাজকতা তৈরি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
“এটা (ষোড়শ সংশোধনী) যদি হয়ে যায় তাহলে হাই কোর্টের জজদের তো আপনি (প্রধান বিচারপতি) কিছু বলতে পারবেন না। ওনারা যদি ১১টায় আসে, তখনও কিছুই বলতে পারবেন না। আবার খাস কামরায় কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যখন কথা বলবেন, তখন সংসদ কি দেখবে? তাকে (সংসদ) কে জানাবে?”
‘সংবিধান সংশোধনকারী সংসদটিই অবৈধ’
ষোড়শ সংশোধনী যে সংসদে পাস হয়েছে সে সংসদ যে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে সেই নির্বাচনকেই ‘অবৈধ’ বলে বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান টিএইচ খান।
ষোড়শ সংশোধনের আগে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা নিয়ে আলোচনার পক্ষে মত দিয়েছেন তিনি। ত্রয়োদশ সংশোধনের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল, যা বিলোপ ঘটে পঞ্চদশ সংশোধনীতে।
ষোড়শ সংশোধনীর অন্তর্নিহিত কিছু বিষয় আছে উল্লেখ তার পরিণতি কী হতে পারে, ভবিষ্যতে কী হতে পারে, বর্তমানে কী হতে পারে তার একটি ব্যাখ্যাও দেন অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারপতি।
একটি বিশ্লেষণে তিনি বলেন, “ষোড়শ সংশোধনী যেটাকে বলা হচ্ছে এবং এটি পাস করেছে যে সংসদ, সেই সংসদ যেভাবে নির্বাচিত হয়েছে, সে নির্বাচনটাই বৈধ না।”
টিএইচ খান বলেছেন, “ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিষয়টি সেটল না করে ষোড়শ সংশোধনীর আলোচনা ঠিক না। এটাকে প্রাসঙ্গিকভাবে দেখতে হবে।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করার ক্ষেত্রে আদালতের রায়ের যে যুক্তি আওয়ামী লীগ সরকার দিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের রায়ে অবসরের পরে স্বাক্ষর করা নিয়েও ধরেন তিনি।
“ত্রয়োদশ সংশোধনী আসলেই আদালত বাতিল করেছিল? আর যদি ত্রয়োদশ সংশোধনী থেকে থাকে, এখনও বহাল থাকে তাহলে ত্রয়োদশ সংশোধনীর যে রায় দিয়েছেন ১৬ মাস পরে, তখন তার (সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক) শপথ ছিল না।”
“অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস আগে তিনি যখন শর্ট অর্ডার দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম এবং একাদশ নির্বাচন হওয়া উচিৎ বলে বলেছিলেন। সেটা মূল রায়ে ছিল না। ওই রায়ের কোনো বৈধতা নেই। কারণ ওই রায়টা যখন দিয়েছেন, তখন তিনি বিচারক ছিলেন না। বিচারক হিসেবে তিনি রায় দেননি।”
ওই রায়ে যে দুজন বিচারপতি স্বাক্ষর করেছেন তারাও কাজটি ঠিক করেননি বলে মন্তব্য করেন টি এইচ খান।
“বাকি চারজন যারা ছিল তাদের মধ্যে বর্তমান প্রধান বিচারপতি আলাদা রায় দিয়েছেন এবং বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি ইমান আলী আলাদা রায় দিয়েছেন। উনারা ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ আইন বলে উনাদের রায়ে উল্লেখ করেছেন। তাহলে প্রশ্ন, ত্রয়োদশ সংশোধনী কে বাতিল করল?”
টি এইচ খান পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, “মজার বিষয় হলো পঞ্চদশ সংশোধনী যেদিন পাস হয়েছে, তার পরে কিন্তু রায় প্রকাশ হয়েছে। রায় প্রকাশের আগেই সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদে পাস করেছে। অথচ সরকার বলেছে, এটা আদালত বাতিল করেছে, আমরা করিনি।”
টি এইচ খান আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করে সেখানে একটা ‘নমিনাল বডি’ না করে একটা ‘ফাংশনাল বডি’ করে ক্ষমতা আরও বাড়ানো উচিৎ বলে মন্তব্য করেন।
যে জিয়াউর রহমানের আমলে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পদ্ধতি প্রবর্তন হয়, তার সরকারে মন্ত্রী ছিলেন টি এইচ খান।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতেই ছিল। বঙ্গবন্ধুর সময় চতুর্থ সংশোধনী হলে তা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয়।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর আওতায় বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ন্যস্ত হয়।
‘পার্লামেন্টারি রিমুভাল কার্যকর হচ্ছে না’
সংসদের হাতে বিভিন্ন দেশে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না বলে দাবি করেন এম আমীর উল ইসলাম।
ষষ্ঠ দিনের শুনানিতে বক্তব্য শুরু করে সপ্তম দিনে অসমাপ্ত বক্তব্য শেষ করেন আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের এই নেতা।
ব্যারিস্টার আমীর সাংবাদিকদের বলেন, “সারা দুনিয়াজুড়ে আমরা যে অবস্থা দেখছি, তাতে বিচারকদের অসদাচারণের কোনো ঘটনা যদি ঘটে, তাহলে সেটা জুডিশিয়ারি ঠিক করবে। সেটাই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল।
“পার্লামেন্টারি রিমুভাল কোনো দেশেই কার্যকর হতে পারছে না। ভারত, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়াতেও, সেখানে আরও বেশি বিতর্কের সৃষ্টি হয় এ নিয়ে। বেশির ভাগ দেশই সংসদ থেকে ফিরে এসেছে। তারা জুডিশিয়াল কাউন্সিলের উপরই দায়িত্ব দিয়েছ। যদি কোন জাজ ভুল করে তার বিচার জুডিসিয়ারিই করবে।”
বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে রেখে ১৯৭২ সালে যে সংবিধান প্রণয়ন হয়েছিল, তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন আমীর-উল ইসলাম। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি।
তখন পক্ষে থাকার পর এখন বিরোধিতার বিষয়ে তিনি বলেন, “তখন তো আমরা জুডিসিয়ারি গড়ে তুলতে পারিনি। আমাদের প্রধান বিচারপতি কে হবেন সেটাও… বঙ্গবন্ধু ফেরার পর ১০ জানুয়ারি, ১১ জানুয়ারি আমরা প্রধান বিচারপতি খুঁজেছি, কাউকে তো শপথ নিতে হবে।
“প্রধান বিচারপতি হিসেবে সায়েমকে নিয়ে আসলাম। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি তো সামরিক শাসকের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন। সময়ের কারণে সে সময়ে আমরা জুডিসিয়ারি গড়তে পারিনি। তখন আপাতত সংসদের হাতে দিয়েছিলাম। কেননা তখন সংসদ ছাড়া আর কিছু গড়ে ওঠেনি।”