হেফাজত ও আওয়ামী লীগ যার মধ্যে একাকার
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: অবশেষে হেফাজতে ইসলামের দাবি মেনে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য সরানোই হলো। এর আগে তাদের দাবি মেনে সরকার পাঠ্যপুস্তকে ব্যাপক সংশোধনী এনেছে। দুটি খবরই ব্যাপক আলোচিত। এই ফাঁকে একটি খবর অনেকের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে। তা হলো গত বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গনে হেফাজতে ইসলাম ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা একজোট হয়ে রফিউর রাব্বির বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছেন।
কিছুদিন আগে নারায়ণগঞ্জের হেফাজতে ইসলামের এক নেতা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ এনে নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বির বিরুদ্ধে মামলা করেন। সেই মামলায় রফিউর রাব্বি গতকাল শনিবার আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করলে বিচারক তা মঞ্জুর করেন। রাব্বির বিরুদ্ধে স্লোগানের আয়োজন তখনই অনুষ্ঠিত হয়। নারায়ণগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণে যা হলো, তাকে আমরা জাতীয় রাজনীতির আঞ্চলিক নমুনা বলতে পারি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও হেফাজতে ইসলামের মধ্যে যে সখ্য গড়ে উঠছে, তাতে ভবিষ্যতে জাতীয় পর্যায়ে দল দুটির মধ্যে রাজনৈতিক জোট গড়ে উঠলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই!
আবার এ মাসেই ছাত্রলীগ নারায়ণগঞ্জে উন্মেষ সাংস্কৃতিক সংসদের আয়োজনে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান পণ্ড করে দেয়। সেখানে তারা রফিউর রাব্বিকে শহীদ মিনারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা ও তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করে। এরপর মাঠে নামেন স্বয়ং শামীম ওসমান। এটা এখন অনেকটাই ওপেন সিক্রেট যে নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান গংয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কারণেই রফিউর রাব্বির পুত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে খুন করা হয়েছে। আর এখন যাতে তিনি পুত্র হত্যার বিচার প্রার্থনা থেকে দূরে থাকেন, সে জন্যই তাঁকে নানাভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে।
সরকার যেভাবে জনতুষ্টিবাদের রাজনীতিতে ঝুঁকছে, তাতে আমরা শেষমেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? হেফাজতে ইসলামের কথায় পাঠ্যবইয়ে সংস্কার আনা হয়েছে, ভাস্কর্য অপসারণ করা হয়েছে। উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরিত হতে গেলে যেখানে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা ও জ্ঞান নির্মাণে সরকারের অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার, সেখানে এসবের মাধ্যমে আমরা কী অভীষ্ট অর্জন করব? তবে কওমি মাদ্রাসা কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা ভালো উদ্যোগ। মাদ্রাসা ও ধর্মীয় শিক্ষাকে অবহেলা করাও সমীচীন নয়। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন হতে পারে না। তাই তাদের ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষাও দেওয়া দরকার।
ভোটের রাজনীতির জন্য একটি দল অনেক কৌশলই নিতে পারে। আজকের যুগে ভোটের রাজনীতিতে আদর্শবাদিতার স্থান নেই। সারা পৃথিবীতেই এমনটা দেখা যাচ্ছে, যার চূড়ান্ত নিদর্শন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু গণতন্ত্র সংহত করতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নাগরিকের ভূমিকা অপরিসীম। বিশেষ করে, মানুষের মন জাগানোয় সাংস্কৃতিক চর্চার বিকল্প নেই। এর অর্থ এই নয় যে সাংস্কৃতিক চর্চা করলেই কেউ সাফসুতরো হয়ে যান। কিন্তু এর বিকল্প নেই। অন্যদিকে, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নাগরিকেরা রাষ্ট্রের ওপর নজরদারি করতে পারেন। রাষ্ট্র ভুল পথে গেলে তাকে শুধরে দিতে পারেন। সে কারণে আমাদের সমাজে রফিউর রাব্বিদের মতো মানুষের বড় প্রয়োজন। ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষেরাও এই কাজে অংশ নিতে পারেন। সেটা হলে বরং সমাজ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, উদারনীতির বিস্তার ঘটে। তবে এর জন্য দরকার সহনশীলতা, কেবল শিক্ষাই যা নিশ্চিত করতে পারে।
নারায়ণগঞ্জে যা হলো, তা স্রেফ মস্তানির ভিন্ন এক রূপ। এত দিন সন্ত্রাসীরা বাহুবলে প্রতিবাদকারীদের দাবিয়ে রাখত। এখন তারা আরেকটু চৌকস হয়েছে। জাতীয় রাজনীতির সূত্রে তাঁরা এখন ধর্মও ব্যবহার করছে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের আদর্শ বলে যে কিছু আর নেই, তা বোঝা গেল। আদর্শের জায়গাটা তারা এখন জনতুষ্টিবাদ দিয়ে পূরণ করছে। ফলে উদার ও গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। অন্যদিকে, সাংস্কৃতিক মহলেরও আত্মজিজ্ঞাসার প্রয়োজন আছে, তাদের ব্যর্থতার কারণে সরকার হেফাজতের সঙ্গে একাকার হচ্ছে কি না।