গণশৌচাগারের পরিবেশ বাসার শৌচাগারের চেয়ে ভালো
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: দূর থেকেই দুর্গন্ধের ঝাপটা নাকে লাগে। নাক চেপেও টেকা দায়। নোংরার জন্য পা রাখার জো নেই। দরজা আছে তো ছিটকিনি নেই। ছিটকিনি আছে তো দরজার তলা নেই। দেয়ালে অশ্লীল কথাবার্তা। হাত ধোয়ার সাবান তো কল্পনার বাইরে। ঢাকার গণশৌচাগারের কথা মনে হলে ভেসে উঠবে এই চিত্র।
কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টেছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকার ১০টি গণশৌচাগারের চেহারা একদম বদলে গেছে। দেয়াল-মেঝে ঝকঝকে। মাথার ওপরে ঘুরছে বৈদ্যুতিক পাখা। প্রতিটি গণশৌচাগারে নারী, পুরুষ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা কক্ষ, ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ, টিস্যু পেপার, হ্যান্ডওয়াশ, বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি ও গোসলের ব্যবস্থা আছে। আছে শৌচাগার ব্যবহারকারীদের জন্য লকার। বাইরে আছে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা। আছেন পেশাদার পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও নারী নিরাপত্তাকর্মী।
বাহাদুর শাহ পার্ক, মুক্তাঙ্গন, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, মানিকনগর, ওসমানী উদ্যান, লালবাগ ও পান্থকুঞ্জ পার্কে নির্মাণ করা হয়েছে এসব গণশৌচাগার। ডিএসসিসির সহযোগিতায় এসব গণশৌচাগার নির্মাণ করেছে বেসরকারি সংস্থা ওয়াটারএইড।
ওয়াটারএইডের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ওসমানী উদ্যানের একটি গণশৌচাগার ব্যবহার করেছে ১ লাখ ২১ হাজার ৬৫৬ জন। গড়ে দিনে শৌচাগার ব্যবহার করেছে ৭৮৫ জন।
জানতে চাইলে ডিএসসিসির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, ‘এখন নগরের টয়লেটগুলোয় ঢুকলে মনে হবে, ফাইভ স্টার হোটেলের ওয়াশরুম। নান্দনিক নকশার এমন টয়লেট অনেকের বাসাবাড়িতেও নেই।’ তিনি বলেন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে আগে নারীরা গণশৌচাগার ব্যবহার করতেন না। শিশু বা প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে এসব শৌচাগার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ডিএসসিসির বিদ্যমান শৌচাগারগুলোও আধুনিকায়নের কাজ চলছে।
ডিএসসিসি প্রকৌশল দপ্তর সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে ঢাকা শহরের গণশৌচাগার মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করতে ডিএসসিসি, ঢাকা ওয়াসা ও ওয়াটারএইডের মধ্যে চুক্তি হয়। এই চুক্তির আওতায় বাহাদুর শাহ পার্কের ভেতর একটি, মুক্তাঙ্গনে একটি, ওসমানী উদ্যানে দুটি, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকায় তিনটি, মানিকনগরে একটি, লালবাগে একটি ও পান্থকুঞ্জ পার্কে একটি করে গণশৌচাগার নির্মাণ করেছে ওয়াটারএইড। একেকটি গণশৌচাগার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা। এখন কমলাপুর রেলস্টেশন, সদরঘাট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা কালীমন্দির ও পুরান ঢাকার বাংলাদেশ মাঠ এলাকায় আরও ছয়টি শৌচাগার নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে।
এদিকে গত নভেম্বর থেকে ডিএসসিসির বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে ১২ কোটি ২৯ লাখ ৪৩ হাজার টাকা ব্যয়ে নগরের বিভিন্ন স্থানে ৪৭টি নতুন গণশৌচাগারের নির্মাণকাজ চলছে। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকার ১৭টি গণশৌচাগার সংস্কার ও উন্নয়নে ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় করছে ডিএসসিসি।
পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের উত্তর-পূর্ব পাশে মাস ছয়েক আগে একটি গণশৌচাগার নির্মাণ করেছে ওয়াটারএইড। সরেজমিনে দেখা যায়, গণশৌচাগারে নারীদের জন্য তিনটি কক্ষ, পুরুষদের জন্য ছয়টি কক্ষ আছে। আছে গোসলের জন্য পৃথক কক্ষ। শৌচাগারের ভেতর সুগন্ধি স্প্রে করা। মাথার ওপরে ঘুরছে বৈদ্যুতিক পাখা। প্রধান ফটকে টিকিট কেটে শৌচাগার ব্যবহার করছে মানুষ। ভেতর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
গত বৃহস্পতিবার মুক্তাঙ্গনের গণশৌচাগারে গিয়ে কথা হয় আজিমপুরের বাসিন্দা মুজাহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাসার শৌচাগারের চেয়ে গণশৌচাগারের পরিবেশ ভালো। ভেতরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস আছে। এভাবে নগরের সব জায়গায় গণশৌচাগার নির্মাণ করলে নাগরিক দুর্ভোগ লাঘব হবে।
সায়েদাবাদের গণশৌচাগারের সামনে কথা হয় রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আসমা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, নানা কাজে নারীদের ঘরের বাইরে যেতে হয়। কিন্তু প্রয়োজন পড়লেও আগে তাঁরা গণশৌচাগার ব্যবহার করতে পারতেন না। নোংরা আর দুর্গন্ধে গা রি রি করত। কিন্তু নতুন গণশৌচাগারে নিরাপত্তাব্যবস্থা ভালো। আছেন নারী নিরাপত্তাকর্মী।
বৃহস্পতিবার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের গণশৌচাগার ব্যবহার করেন ফেনীর বাসিন্দা কাউছার আলম। তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে দুটি ব্যাগ ছিল। এগুলো কোথায় রাখব, তা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। পরে দেখি ব্যাগ রাখার জন্য আলাদা জায়গা (লকার) আছে।’
পান্থকুঞ্জ পার্কে গণশৌচাগারে টিকিট বিক্রির কাজে নিয়োজিত ওয়াটারএইডের এক কর্মী বলেন, ‘পাঁচ টাকার রসিদ নিয়ে এই শৌচাগারের সেবা মিলবে। কেউ গোসল করতে চাইলে ১০ টাকা লাগবে। এক টাকা দিয়ে ওয়ান টাইম গ্লাসে বিশুদ্ধ খাওয়ার পানিও পাওয়া যাবে। সাধারণ মানুষের হাত-মুখ ধোয়ারও ব্যবস্থা আছে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল মানুষ বিনা মূল্যে এখান থেকে সেবা গ্রহণ করতে পারবেন।’ তবে তাঁর অভিযোগ, অনেকে টাকা না দিয়ে জোর করে শৌচাগার ব্যবহার করেন।
২০১০ সালে সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ এবং ওয়াটারএইডের যৌথ উদ্যোগে চালানো সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৫৫ লাখ মানুষের গণশৌচাগার ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে ভাসমান মানুষ পাঁচ লাখ। রিকশাচালক ১০ লাখ। অন্যান্য জীবিকার মানুষ ১০ লাখ। নিয়মিত পথচারী ২০ লাখ। ঢাকার বাইরে থেকে আসা পথচারী ১০ লাখ।
ওয়াটারএইডের প্রকল্প পরিচালক এ বি এম মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ঢাকা শহরে জনসংখ্যার তুলনায় গণশৌচাগারের সংখ্যা অনেক কম। মানুষের দুর্ভোগ মেটাতেই এসব শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, গণশৌচাগারে টিকিট বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থে পরিচালন ব্যয় মেটানো হয়। পর্যাপ্ত টাকা না থাকলে ওয়াটারএইডের তহবিল থেকেও দেওয়া হয়।