বনসাই বিতর্কে পিছু হটেছে সওজ
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: বিতর্কের মুখে বিমানবন্দর-বনানী সড়কে বনসাই লাগানোর কাজ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। তবে সেখানে শোভাবর্ধনের কাজ চলবে। বনসাইয়ের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামত নেওয়া হবে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, বিমানবন্দর সড়ক থেকে বনানীর দিকে আসতে নিকুঞ্জ পর্যন্ত রাস্তায় প্রায় এক শ বটজাতীয় বনসাইগাছ লাগানো হয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) কর্মকর্তারা জানান, বনানী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে অত্যাধুনিকভাবে সাজানোর অংশ হিসেবে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। কাজটি পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভিনাইল ওয়ার্ল্ড গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি চীন থেকে এনে ফাইকাস বনসাইগুলো লাগায়।
কৃষ্ণচূড়া, সোনালু, রাধাচূড়া, কদমসহ রঙিন সব দেশি ফুল যখন রাজধানী রাঙায়, তখন বিমানবন্দর সড়কের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এ ধরনের বনসাই লাগানো নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সাগর লোহানী ফেসবুকে লেখেন, ‘বড় বড় গাছ কেটে ছায়াহীন নিষ্ঠুর বনসাই বসিয়ে পথচারীদের কী উপকার হবে জানি না। এয়ারপোর্ট রোডের তথাকথিত সৌন্দর্যবর্ধনের নামে যা হচ্ছে, তা পরিবেশের সাথে নির্মমতা। নগরবাসীর সঙ্গে প্রতারণা। ভিনাইল গ্রুপ নিশ্চয়ই দাতা হাতেম তাইয়ের প্রতিষ্ঠান নয়। এই ছয় কিলোমিটার রাস্তা নিশ্চয়ই স্পনসরের নামে ভাড়া দেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে ১০ বছরে সরকার কত রাজস্ব হারাবে? জানি, এসবের উত্তর কেউ দেবেন না।’
বাংলাদেশি প্রকৃতিবিদ, লেখক দ্বিজেন শর্মা বলেন, ‘১৫-২০ বছর আগে বিমানবন্দর সড়কের দুই পাশে প্রচুর নাগেশ্বরগাছ ছিল। খুব সুন্দর দেখাত। বিএনপির আমলে রাতের আঁধারে কিছু গাছ কেটে ফেলা হলো। এরপর দাম দিয়ে বিদেশি কিছু গাছ লাগানো হলো। এখনো দেখছি সেই একই কাজ হচ্ছে। অথচ আমাদের প্রচুর বড় বড় গাছ দরকার, যেগুলো আমাদের ছায়া দেবে। অক্সিজেন দেবে।’
গতকাল সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বনসাই লাগানো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হওয়ায় সড়ক পরিবহন বনসাই লাগানো বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির ফুল ও শোভাবর্ধক গাছ লাগানোর মধ্য দিয়ে এ সড়কের দুই পাশ সবুজায়ন করা হবে। এখানে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ গাছের চারা লাগানো হবে।
অবশ্য গাছ লাগানো ছাড়াও এই প্রকল্পে ডিজিটাল যাত্রীছাউনি, আধুনিক ডাস্টবিন, এলইডি মনিটর, ফ্রি ওয়াই-ফাই সংযোগ, আধুনিক টয়লেট, কৃত্রিম ঝরনাসহ আরও কাজ করার কথা বলা হচ্ছে। এ জন্য নব্বই কোটি টাকা খরচ হবে। রক্ষণাবেক্ষণসহ প্রকল্পের মোট বাজেট ১৪০ কোটি টাকা। মেয়াদ ১০ বছর। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই পুরো খরচ বহন করছে। বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানটি নির্ধারিত স্থান বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে ভাড়া দিয়ে এই খরচ তুলে নেবে। তবে এই বিজ্ঞাপন বা বিলবোর্ডের জন্য সিটি করপোরেশনের অনুমতি পাওয়া না-পাওয়া নিয়েও প্রশ্ন আছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ওই সড়কে থাকা বিলবোর্ডগুলো আমরা সম্প্রতি ভেঙে দিয়েছি। নতুন করে কেউ করতে চাইলে আমাদের কাছে অনুমতি চাইতে আসবে। তখন দেখা যাবে কী সিদ্ধান্ত হয়।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ভিনাইল ওয়ার্ল্ড গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবেদ মনসুর বলেন, ‘আমরা ফেব্রুয়ারি থেকে বনানী-এয়ারপোর্ট ছয় কিলোমিটার রাস্তা সৌন্দর্যকরণের কাজ শুরু করেছি। কাজ শেষ হলে দেখবেন, এই এলাকার চেহারা বদলে গেছে। চীন ও তাইওয়ান থেকে এক শটি বনসাই এনে লাগানো হয়েছে। এখানে যেমন ১৫ ফুট গাছ আছে, সামনে ৪০ ফুট উঁচু গাছও আসবে। শুধু বনসাই নিয়েই কথা উঠছে। এখানে আরও চার লাখ ছোট ছোট গাছ লাগানো হবে। বারো মাস যেন সড়কের দুই পাশে ফুল থাকে, সেই বিবেচনাও আছে।’
প্রকৃতিবাদী সংগঠন তরুপল্লবের সাধারণ সম্পাদক মোকারম হোসেন বলেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বিমানবন্দর সড়ক আমরা কীভাবে সাজাব। এর জন্য কমপক্ষে এক শ বছরের একটি বিশেষায়িত পরিকল্পনা দরকার। এমনকি যখন-তখন ইচ্ছেমতো এর আমূল পরিবর্তন করা যাবে না। আগেই যদি এমন একটি পরিকল্পনা থাকত, তাহলে মাত্র তিন দশকে তিনবার এই সড়কের চেহারা বদলাত না। বর্তমানে বনসাই বসিয়ে সৌন্দর্যবর্ধনের যে অপচেষ্টা চলছে, তা অতীতের সব বিশৃঙ্খলাকে ছাড়িয়ে গেছে। সবুজ শ্যামল এই দেশে কি বৃক্ষের এতই আকাল যে বিদেশি বামন গাছ আমদানি করতে হলো?’ তিনি বলেন, এই সড়কে দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে এমন কিছু ‘এভিনিউ ট্রি’ থাকা দরকার। যেমন দেবদারু, গর্জন, তেলসুর ইত্যাদি। একই সঙ্গে নিকটবর্তী জলাশয়গুলোতেও জলজ ফুল থাকতে পারে।