বাহাদুরির নাম রং সাইড
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: ‘রং সাইড’-এর আক্ষরিক বাংলা হতে পারে ‘ভুল দিক’। রাস্তায় চলাচলের বেলায় আমরা অবশ্য একে ‘উল্টো পথ’ হিসেবেই লিখে থাকি। তা ভুল দিক বা উল্টো পথ যা-ই হোক, এমন পথে চলাই এখন বাহাদুরির বিষয়। ঠিক পথ তো আমজনতার পথ, সেখানে আপনি নিজেকে আলাদা করবেন কীভাবে? কীভাবে প্রকাশ পাবে আপনার ক্ষমতা! সবাই যে পথে যায় আপনি যখন তার উল্টো পথে যাবেন, তখনই না টের পাওয়া যাবে আপনার বাহাদুরি!
মন্ত্রী, সাংসদ, সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ-র্যাব, এমনকি সাংবাদিক—অনেক সময়ই তাঁদের যাওয়ার পথ তাই রং সাইড। বাহাদুরি দেখানো একটি সংক্রামক বিষয়। এমন খায়েশ আরও অনেকের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে—এটাই তো স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ সরকারি দল, এর কোনো নেতার জন্য রং সাইড না-জায়েজ থাকবে কেন? রমনা থানার আওয়ামী লীগের নেতা মো. মোখলেসুর রহমান নিজেকে ‘পরিচিত মানুষ’ হিসেবে বিবেচনা করেন। তিনি মনে করেন, ‘সবাই তাকে চেনেন।’ রং সাইডে চলার জন্য এমন একজনকে তো পুলিশের আটকানোর কথা নয়! মোখলেসুর রহমান সম্ভবত পুলিশের আচরণে খুবই বিস্মিত হয়েছেন। পুলিশকে বলেছেন, ‘আমি রং সাইডে যাব, তুই আটকানোর কে?’
যাঁরা নিয়মিত ও কারণে-অকারণে রং সাইডে চলাচল করেন, তাঁদের চেয়ে রমনা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি নিজেকে কম বাহাদুর মনে করবেন কেন! আর তিনি তো ইফতার পার্টি ধরতে রং সাইড নিয়েছিলেন। এখানে তো দেরি করার সুযোগ নেই। ফলে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মগবাজার মোড় এলাকায় রমনা থানার যে পুলিশ উপপরিদর্শক তাঁকে আটকে দিয়েছিলেন, তিনি তাঁকে যাচ্ছেতাই গালিগালাজ করেছেন। পুলিশ তাঁকে আটকাতে তো পারেইনি, বরং ইফতারের পর কিছু যুবক এসে নাকি সেই পুলিশ কর্মকর্তাকে হুমকি-ধমকি দিয়ে গেছে। রমনা থানার ওসি জানিয়েছেন, এ ঘটনার তদন্ত চলছে। তদন্তের কী ফল মিলবে, কে জানে!
আমরা বরং উল্টো পুলিশকে প্রশ্ন করতে পারি, তারা কেন উল্টো পথে আসা একটি গাড়ি আটকাতে গেল? পুলিশের গাড়ি অহরহ উল্টো পথে চলে। মন্ত্রী বা সাংসদের উল্টো পথে চলা গাড়িগুলোকে তো পুলিশ কখনো বাধা দেয় না। বরং অনেক ‘ভিআইপির’ গাড়ি পুলিশ রং সাইড দিয়ে নিজেই পাহারা দিয়ে নিয়ে যায়। রমনা থানার পুলিশ কেন রমনা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতিকে একজন ‘ভিআইপি’ হিসেবে বিবেচনা করল না? পুলিশের কাছে এসব প্রশ্নের কোনো জবাব আছে বলে মনে হয় না। তাদের কাছ থেকে নানা অসহায়ত্বের কথা শোনা যায়।
যেভাবে চলছে তাতে তো এমনই হওয়ার কথা! ঢাকার অন্য কোনো থানার আওয়ামী লীগের সভাপতিও রং সাইডে চলতে বাধা পেলে একই কাজ করবেন। যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতারাও রং সাইড ধরবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস রং সাইডে চলবে, এটা তো নিয়মেই পরিণত হয়েছে। তাদের বাধা দিলে কী পরিণতি ভোগ করতে হয় তা সম্প্রতি আবার টের পাওয়া গেল বিজয় সরণির কাছে। গত বৃহস্পতিবারের ঘটনা। শিক্ষার্থীদের বহনকারী একটি বাসের উল্টো পথে চলার ঘটনায় আহত হয়েছেন দুই মোটরসাইকেল আরোহী। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসটিকে উল্টো পথে চলতে বাধা দিয়ে মারধর খেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি বাসের চালক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেকেই ভবিষ্যতে মন্ত্রী-সাংসদ হবেন। অনেকে সরকারি কর্মকর্তা হবেন, কেউ কেউ পুলিশ-র্যাবের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে ঢুকবেন। অনিয়মকে নিয়ম ভাবার বা রং সাইডে চলার শিক্ষাটি তাঁদের শিক্ষাজীবন থেকেই হয়ে যাচ্ছে! আমরা যে চক্রের মধ্যে পড়ে গেছি, তাতে রং সাইডে চলা বন্ধ করা যাবে বলে মনে হয় না।
আমাদের যোগাযোগমন্ত্রী ও সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক গত কোরবানির ঈদের আগে রং সাইডে গাড়ি চলা নিয়ে বেশ কড়া কড়া কথা বলেছিলেন। ‘পুলিশকে বলা হয়েছে রং সাইডে যাঁরাই যাবেন; তিনি মন্ত্রী হন, এমপি হন, ভিআইপি হন, যে-ই হন সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাঁর বিরুদ্ধেও ঠিক একই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যে গাড়িই রং সাইড দিয়ে যাবে, সেই গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হবে।’ তাঁর কথায় কোনো কাজ হয়নি। পুলিশ তাঁর নির্দেশ মেনে কিছু করতে পারেনি।
দাপট ও বাহাদুরি দেখানো ভিআইপির সংখ্যা সীমিত থাকলে পুলিশের পক্ষে হয়তো কিছু করা সম্ভব ছিল। কিন্তু এ ধরনের মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। ঢাকার রাস্তায় যাঁরা চলাচল করেন, তাঁরা খেয়াল করলে দেখবেন আপনার বাহনের সামনে-পেছনে বা ডানে-বাঁয়ে কোনো না কোনো গাড়ি থেকে ভিআইপি হর্ন বেজেই চলেছে। জ্যামের মধ্যেই এই হর্নগুলো অসভ্যের মতো বাজতে থাকে! তাকিয়ে দেখেছি গাড়ির মধ্যে ভিআইপিরা দিব্যি বসে আছেন। চলকের অহেতুক হর্ন নিয়ে তাঁদের আদৌ কোনো বিকার নেই। ভিআইপি হর্নের বাহাদুরিটা হয়তো তিনি গাড়িতে বসে উপভোগ করেন!
আমরা ধরে নিতে পারি যে রং সাইডে গাড়ি চলা বন্ধ করা সম্ভব হবে না। কিন্তু সবাই এই পথ ধরলে তো এর কৌলীন্য নষ্ট হবে। রং সাইডে বাহাদুরি ধরে রাখতে কারা কারা উল্টো পথে চলতে পারবে, তা ঠিক করে দিলেই হয়। ট্রাফিক পুলিশের তরফে রং সাইডে চলার অধিকার দিয়ে স্টিকারও ছাড়া যেতে পারে। সেই স্টিকারওয়ালা গাড়িগুলো দেখলে আমরা আমজনতারা ভিআইপি বাহাদুরদের গাড়িগুলো চিনতে পারব! সমঝে চলতে পারব। আর কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে ভুল করে গাড়ি থামিয়ে গালিগালাজ ও তুই-তোকারি শুনতে হবে না!
এ কে এম জাকারিয়া (সাংবাদিক)