নির্বাচন নিয়ে দুই মহাসচিব
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, কোন সরকারের অধীনে হবে, সেসব নিয়ে বিস্তর মতপার্থক্য থাকলেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপির মহাসচিব প্রায় প্রতিদিনই নির্বাচন নিয়ে দেশবাসীকে সবক দিয়ে চলেছেন। দলীয় নেতা-কর্মীদের চাঙা করাই এর উদ্দেশ্য। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নির্বাচন নিয়ে এত কোন্দল হয় না।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবার জাতীয় সংসদে ‘সর্বকালের সেরা বাজেট’ উত্থাপন করলেও সেখানে উত্তাপ কম। কারণ, সংসদে প্রকৃত বিরোধী দল নেই। জাতীয় পার্টি নামে যে বিরোধী দলটি আছে, তারা আবার সরকারেরও অংশ। দলের প্রধান প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। ফলে সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার ‘যোগ্যতা’ তাদের নেই। তবে সরকারি দলেরই কোনো কোনো সাংসদ মৃদু কণ্ঠে বাজেটের সমালোচনা করছেন। কেউ কেউ অর্থমন্ত্রীকে জেদ বজায় না রাখতে বলেছেন। কিন্তু সংসদের বাইরে বাজেটের উত্তাপটা ভালোভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। প্রস্তাবিত বাজেট ব্যাপকভাবে সংশোধন না হলে জনগণের ওপর যে অস্বাভাবিক চাপ বাড়বে, তা হলফ করে বলা যায়।
বাজেটের বিষয়টি আমরা অর্থমন্ত্রীর বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিয়ে এখন নির্বাচনের দিকে চোখ ফেরাই। সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে সরাসরি বাক্যালাপ না থাকলেও নির্বাচন নিয়ে তাঁরা নিয়মিত কথা বলছেন। আওয়ামী লীগের কোনো নেতা একটি কথা বললে বিএনপির নেতা জবাব দিচ্ছেন। আবার বিএনপির কোনো নেতা অভিযোগ আনলে পাল্টা অভিযোগ আনছেন আওয়ামী লীগের নেতা। কেউ প্রতিপক্ষের কোনো কথা মাটিতে পড়তে দিচ্ছেন না। মারামারি-কাটাকাটির চেয়ে এটা ভালো। এটিও একধরনের সংলাপ। পরোক্ষ সংলাপ। আশা করি, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এই বাগ্যুদ্ধ চলবে।
গত শনিবার কুমিল্লায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্য কোনো ব্যক্তিকে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। তিনি খুবই খাঁটি কথা বলেছেন। কিন্তু বর্তমান সংসদে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে কতজন আগামী নির্বাচনে গ্রহণযোগ্য হবেন, সেসব নিয়ে আওয়ামী লীগ মহলে নানা জল্পনার পাশাপাশি উৎকণ্ঠাও রয়েছে। ২০১৪ সালের মতো একতরফা নির্বাচন হলে কলাগাছও পাস করবে। কিন্তু বিএনপি নির্বাচনে এলে আওয়ামী লীগকে ভেবেচিন্তেই প্রার্থী ঠিক করতে হবে। নির্বাচনী এলাকার জনমত জরিপ করে নাকি সম্ভাব্য প্রার্থীদের একটি তালিকা দলীয় সভানেত্রীর কাছে দেওয়া হয়েছে। বিএনপির নেতারা শেখ হাসিনার অধীনে কোনো অবস্থায় নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বললেও তাঁরা ৩০০ আসনে ৯০০ প্রার্থীর একটি তালিকা তৈরি করে রেখেছে। সম্প্রতি কয়েকজন সংস্কারপন্থী নেতাকে দলে নেওয়া হয়েছে, সেই বিবেচনা থেকেই। দেখা যাক, কোথাকার তালিকা কোথায় গিয়ে ঠেকে।
আওয়ামী লীগ গ্রহণযোগ্য প্রার্থীর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে দলটি যাঁদের মনোনয়ন দিয়েছিল, তাঁদের অনেককে জনগণ গ্রহণযোগ্য মনে করেনি। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীরা দলে দলে হার মেনেছিল বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছে। মারামারি লাঠালাঠিও হয়েছে আওয়ামী লীগ বনাম ‘আওয়ামী লীগ’, ‘মনোনীত’ বনাম ‘বিদ্রোহী।’
দুই প্রধান দলের নেতারাই যখন কে কটি আসন পাবেন এবং কতবার জয়ের মুকুট পরবেন, এ ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত, তখন ধরে নিতে পারি ২০১৮ বা ২০১৯ সালে যে নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে, সেটি ২০১৪-এর মতো হবে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন দেশবাসী দেখতে চায় না। অতএব, কেবল প্রার্থী গ্রহণযোগ্য হলেই হবে না, নির্বাচনও হতে হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য। আর বিএনপিকে উপলব্ধি করতে হবে যে নির্বাচন বর্জন কোনো সমাধান নয়। মাঠ ছেড়ে দিলে প্রতিপক্ষই লাভবান হবে। অতএব, লন্ডনের ওহি শুনে ঢাকায় বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।
ফেনীতে জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে কে কত সিট পাবে, তা নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের জনগণ। বিএনপির নেতা মির্জা ফখরুল কীভাবে ঐশী বাণী পেলেন যে আওয়ামী লীগ ৩০ সিট পাবে? মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আগে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে হ্যাটট্রিক জয় ছিনিয়ে নেবে। আর বিএনপির জন্য অপেক্ষা করছে হ্যাটট্রিক পরাজয়। দুটিই ভবিষ্যদ্বাণী। দ্বিতীয় ভবিষ্যদ্বাণী ঐশী হলে প্রথমটিও জাগতিক হতে পারে না। রাজনীতির আরেক জ্যোতিষী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, আগামী নির্বাচনে তাঁরা ১০০ আসন পাবেন। তাঁর দেশের বৃহত্তম জোট বাঁধতে না বাঁধতেই তাতে ভাঙন ধরেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি চলছে ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে। কেউ রূপকল্প ২০৪১ ঘোষণা করছেন, কেউ ২০৩০-এর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। কিন্তু জনজীবনের বর্তমান সমস্যা নিয়ে কেউ ভাবেন বলে মনে হয় না।
আমাদের নেতা-নেত্রী ভোটারদের ওপর আস্থা না রেখে ভোটের আগেই আসন বণ্টন করে ফেলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ভোটাররা এমন রায় দেন যে ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টারা লজ্জা পেয়ে যান। তাই দুই দলের ‘মহাসচিব দ্বয়কে’ অনুরোধ করব, নির্বাচনের আগে জয়-পরাজয় নির্ধারণ না করে সেই দায়িত্বটি ভোটারদের ওপর ছেড়ে দিন। ভোটারদের ওপর ভোটের দায়িত্ব ছেড়ে দিলে প্রতিবার নির্বাচন নিয়ে এত মারামারি-কাটাকাটির প্রয়োজন হতো না। নির্বাচন নিয়ে বিদেশি সালিস ডাকারও দরকার হবে না।