ঢাকার বুকে ছোট ছোট ভবদহ !
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: সোমবার সকালে বৃষ্টি মাথায় বাসা থেকে বের হলাম। অফিসে যাব। বেশ কয়েক দিনের ভ্যাপসা গরমের পর এমন বৃষ্টি। মিষ্টি একটা আমেজে মনটা ভিজে গল। তবে শিগগিরই খরতাপের আঁচ পেলাম। রিকশাচালক দ্বিগুণ ভাড়া চেয়ে বসলেন। বৃষ্টি—তাই কোনো ছাড় নেই। এদিকে রিকশার তুলনায় যাত্রী বেশি। অগত্যা আমি নাচার। ওই দ্বিগুণ ভাড়াই সই। যেতে যেতে সেই একঘেয়ে অপ্রিয় দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। রাস্তার পাশে ময়লার স্তূপ বৃষ্টিতে ভিজে ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। খানাখন্দ ভরা পানি। ম্যানহোলের ঢাকনা উপচে বয়ে যাচ্ছে কালো পানি।
এই গা-ঘিন ঘিন অনুভূতি নিয়ে অফিসে পা দিয়ে দেখি, প্রায় সব সহকর্মীই একই দুর্ভোগ পোহায়ে এসেছেন। কারও কারও দুর্গতি আরও বেশি। বসুন্ধরা সিটির পেছনে পশ্চিম তেজতুরী বাজারে আবাসিক এলাকায় থাকা এক সহকর্মী জানান, সকালে উঠে দেখেন বাসার সামনে হাঁটুপানি। রাত আর সকালের বৃষ্টি মিলিয়ে এই দশা। কী করবেন? রিকশাচালককে নগদে ৫০ টাকা ছাড় করে পানিডোবা পথটুকু পাড়ি দিয়ে এসেছেন। সহকর্মী বললেন, ‘ভাইয়া, পানির চেহারা যদি দেখতেন—ইশ্, মরে যেতে ইচ্ছা করে!’ এই সহকর্মী বিকেলে প্রায় দুঘণ্টা অপেক্ষা করে এক রিকশাচালককে ১০০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে তবেই পানিপথ পেরোতে পেরেছিলেন। অথচ তা এক মিনিটের পথও নয়।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকাও নাকি তখন পানিতে থই থই। গাড়িতে আসা আরেক সহকর্মী জানালেন জলজটের দুর্ভোগ পেরিয়ে আসার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা।
বিকেলে যখন অফিস থেকে বের হলাম, তখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। পুরো কারওয়ান বাজার এলাকায় নর্দমা উপচে পানি গড়াচ্ছে। দাঁত খামটি দিয়ে এই কালো পানি মাড়িয়ে রিকশা জোটাতে বড্ড হ্যাপা পোহাতে হলো। পূর্ব তেজতুরী বাজারের এক গলি দিয়ে যাচ্ছি, দুর্গন্ধ ভরা পানিতে হারিয়ে গেছে রাস্তা। রিকশা যত যায়, পানি তত ওপরে ওঠে। একসময় দেখি, কালো পানি সিট ছুঁই ছুঁই! ভয় হতে লাগল। কোথাও কোন গর্তে টক্কর খেয়ে রিকশা যদি উল্টে যায়, তবেই হয়েছে!
খানিক পর এ যাত্রা পার পেলাম তো তেজকুনিপাড়ায় গিয়ে দেখি আরেক ‘ভবদহ’। ফ্লাইওভারের নিচ থেকে শুরু হয়ে ছাপড়া মসজিদের খানিকটা আগ পর্যন্ত পুরো রাস্তায় সেই কালো পানি। এখানেও পানি রিকশার সিট ছুঁই ছুঁই করছে। তেজকুনিপাড়ার রাস্তাটির বর্ষাকালীন এই দুর্গতি আজকের নয়। বছরের পর বছর ধরে দেখছি। সমস্যা দূর করার উদ্যোগ নিতেও তো কম দেখলাম না। সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করে কী যেন করে! তখন সড়কে যান চলাচল ব্যাহত হয়। পথচারী খুব কায়ক্লেশে হাঁটে। কিন্তু পরে আবার যেই ছিল সেই। এ সমস্যার সমাধান নেই কেন, কে জানে?
একটু জোর বৃষ্টি হলেই এ সড়কে পানি জমে। তখন ছোটখাটো একটা ভবদহের সৃষ্টি হয়। আশপাশের মানুষ জলবন্দী হয়ে পড়ে। কখনো কখনো পানি দু-তিন দিন বা তারও বেশি সময় ধরে রাস্তায় গ্যাঁট হয়ে থাকে। লোকজন ভবদহের মানুষের মতো জলবন্দী জীবন কাটায়। যশোরের ভবদহ অঞ্চলে বৃষ্টির পানি জমে, কিন্তু নামে না। এ পরিস্থিতিতে জলবন্দী লাখো মানুষকে পোহাতে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। জলমগ্ন কষ্টের জীবনের সঙ্গে মিশে একাকার হয় এসব অভাগার চোখের জল। ভবদহের জল কমে না, অভাগা মানুষের চোখের জলও শুকায় না। দিনের পর দিন আটকে থাকে। কিন্তু ঢাকার এই খুদে ভবদহগুলোর পানি নেমে যায়। আসল ভবদহের সঙ্গে এসব ভবদহের তফাতটা এখানেই। ক্ষণিকের এই ভবদহে কষ্ট আর দুর্ভোগ কিন্তু কম নয়। জলমগ্ন সড়কের পাশেই একাধিক বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট ভবন। এসব ভবনের বাসিন্দারা অর্থবিত্ত আর প্রভাবে কম নন। কিন্তু বৃষ্টি নামল তো ভবদহের জলবন্দী মানুষের মতো অসহায়।
শুধু এই তেজকুনিপাড়ার কিয়দংশের কথা বললেই এই দুর্গতির কষ্টে ভরা গল্পটি শেষ হবে না। গোটা ঢাকা নগরের চারপাশে রয়েছে এমন ছোট ছোট অগণিত ভবদহ। সোমবারের বৃষ্টিতে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, মগবাজার, মেরুল, বাড্ডা, মৌচাক, নাজিমউদ্দিন রোড, ফকিরাপুল, গ্রিন রোড, পান্থপথের কিয়দংশ, বসুন্ধরা সিটির পেছন দিক, কারওয়ান বাজার, পূর্ব ও পশ্চিম তেজতুরী বাজার, তেজকুনিপাড়া—এসব এলাকায় প্রচুর পানি জমে। কোনো কোনো এলাকায় পানির উচ্চতা ছিল হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত।
কোথাও জরুরি কাজ পড়ে আছে, গাড়ি নিয়ে না গেলেই নয়। কিন্তু বেরোবেন কী করে? সামনে তো পানি। কোনো যুবক চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবেন, অনেক তাড়া। একটু ফিটফাট হয়ে যেতে হবে। তা হবে কী করে? সামনে তো পানি। কোনো শিক্ষার্থীর সকালে পরীক্ষা। গাড়িটা নিলে ভালো। নইলে স্কুটার। আর তা না হলে রিকশা। পাবেন কোথায়? সামনে তো পানি। একজন কর্মজীবী নারী অফিস যাবেন। জরুরি সভায় গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটা হাজির করতে হবে। তিনি বের হবেন কীভাবে? সামনে তো পানি।
এই সমস্যার কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, এসব রাস্তার সুয়ারেজ লাইন বা পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার এমন দুর্দশা যে বৃষ্টির পানি নির্গমনের পথ রুদ্ধ। তা হতে পারে রাস্তার আশপাশের এক বা একাধিক ভবনের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থায় ত্রুটি থাকার কারণে। আবার ভূগর্ভস্থ সেফটি ট্যাংকি বা নির্গমন লাইনে জ্যাম থাকার কারণেও এ পরিস্থিতি হতে পারে। বিভিন্ন সংস্থার ভূগর্ভস্থ লাইন স্থাপন ও লাইন মেরামতে প্রায়ই নগরের বিভিন্ন সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করা হয়। পরে যখন এসব লাইন মাটিচাপা দেওয়া হয়, এ সময়ের কোনো ত্রুটিও পানি নির্গমন পথে জটিল বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তা যা-ই হোক না কেন, বর্ষার সময় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এই জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান হওয়াটা জরুরি।