জঙ্গিবাদ: উদ্বেগের বিপরীতে আশার সন্ধান

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: হোলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসী হামলার এক বছর পূর্তির মুহূর্তে আমরা আরও স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি, আমাদের সমাজে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জনমত কত প্রবল। সেই ভয়ংকর রাতে যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁদের শোকের সঙ্গে সর্বসাধারণের সংহতির পাশাপাশি জঙ্গিবাদকে সর্বান্তকরণে প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। যে কজন বিপথগামী তরুণ সেই রাতে নৃশংস হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল, তাদের অভিভাবকেরা সন্তানের অপরাধের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চাইছেন। তাঁরা আহ্বান জানাচ্ছেন, আর কারও সন্তান যেন ওই ভয়ংকর অন্যায় পথে না যায়।

যেমন হামলাকারীদের একজন, বগুড়ার শফিকুল ইসলামের বাবা বদিউজ্জামান বলেছেন, ‘ছেলের হয়ে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইছি। গত বছরের ওই জঙ্গি হামলার ঘটনায় আমি দেশবাসীর কাছে লজ্জিত ও অনুতপ্ত।…আর কোনো ছেলের যেন এমন কলঙ্কজনক মৃত্যু না হয়। আর কোনো বাবাকে যেন ছেলের জন্য এমন লজ্জিত হতে না হয়।’ শফিকুলের চাচা আফজাল হোসেন বলেছেন, ‘শফিকুল জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হওয়ার পর থেকে মানুষকে মুখ দেখাতে পারি না। সবাই আমাদেরকে জঙ্গি পরিবার বলে উপহাস করে।’

সমাজের প্রত্যাখ্যানের মুখে হোলি আর্টিজানে হামলাকারী জঙ্গিদের পরিবারগুলো প্রায় একঘরে হয়ে আছে। অর্থাৎ, এই সমাজ কোনো ধরনের সহিংসতা সমর্থন করে না। জঙ্গিরা এ সমাজে পথভ্রষ্ট অন্ধকারের প্রাণী হিসেবে ঘৃণিত; তাদের পৈশাচিক পথ এই সমাজ ধিক্কারের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে।

এটা আরব বিশ্বের দেশগুলোর সামাজিক মানসিকতার সঙ্গে আমাদের সমাজের বিরাট পার্থক্য নির্দেশ করে। কারণ, সিরিয়া ও ইরাকে ইসলামিক স্টেট (আইএস) নামের যে জঙ্গিবাদী ইসলামি সংগঠনটি রীতিমতো একটা রাষ্ট্র বা ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, তার পেছনে ছিল আরব সমাজের একটা অংশের জোরালো সমর্থন। জর্ডান, মরক্কো, তিউনিসিয়া, লেবানন থেকে অনেক তরুণ-যুবককে তাঁদের মা-বাবাই টাকা-পয়সা দিয়ে সিরিয়া পাঠিয়েছেন তথাকথিত ‘জিহাদ’ করার উদ্দেশ্যে। আর আইএস সিরিয়া ও ইরাকের যেসব শহর ও অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পেরেছে, সেগুলোতেও বিপুলসংখ্যক মানুষ তাদের সমর্থন জুগিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে জঙ্গিদের প্রতি সমাজের কোনো অংশের সাধারণ সমর্থন আছে, এমন তথ্য পাওয়া যায় না। এখানে জঙ্গিদের কাজ করতে হয় অত্যন্ত গোপনে, লোকচক্ষুর অন্তরালে। ফলে এ দেশে জঙ্গি তৎপরতার ব্যাপক বিস্তার সম্ভব বলে মনে হয় না।

কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে জঙ্গিবাদের বিপদ আরও বাড়ার কোনো আশঙ্কা নেই। এ রকম আশঙ্কা অবশ্যই আছে, কারণ আইএস ও আল-কায়েদার মতো জঙ্গি সংগঠনগুলো বৃহত্তর সমাজের সমর্থন পাওয়ার আশা বা চেষ্টা ছাড়াই তাদের তৎপরতা চালিয়ে যেতে পারে। দেশে দেশে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর জঙ্গিবিরোধী প্রবল অভিযান, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ক্রমবর্ধমান নজরদারি ও জনসাধারণের ক্রমশ সচেতন হয়ে ওঠার ফলে জঙ্গিদের চলাফেরা, সদস্য সংগ্রহ করা, হামলা সংগঠিত করা ও হামলা চালানো ক্রমেই আরও কঠিন হয়ে উঠছে বলে এই জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের কৌশল পাল্টাচ্ছে। ধর্মপ্রাণ তরুণ-যুবকদের তথাকথিত জিহাদি ভাবাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য তারা আরও বেশি করে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে।

দেখা যাচ্ছে, আইএসএর মতো জঙ্গি সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের প্রায় সবাই শিক্ষিত, অনেকে উচ্চশিক্ষিত এবং আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে পারঙ্গম। আইএসের একটা প্রচারণা শাখা আছে, সেটা মূলত তথ্যপ্রযুক্তি-নির্ভর। তাদের ভাবাদর্শের অনুসারী অজস ওয়েবসাইট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অত্যন্ত সক্রিয়। এসব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তরুণ সমাজের মধ্যে র‍্যাডিক্যালাইজেশন বা জঙ্গিবাদী ভাবাদর্শের বিস্তার ঘটছে। এমন তরুণ-যুবকও আছে, যারা এখনো কোনো জঙ্গি সংগঠনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়নি, কিন্তু তথাকথিত জিহাদি ভাবধারার প্রতি মৃদু সমর্থন বোধ করে। এই ধরনের তরুণদেরই আইএস তাদের যোদ্ধা বানানোর চেষ্টা করে। আইএসের ভাবাদর্শের অনুসারী বাংলাদেশের নব্য জেএমবির অন্যতম নেতা তামিম চৌধুরী থেকে শুরু করে হোলি আর্টিজানের হামলাকারী নিবরাস ইসলাম ও রোহান ইমতিয়াজের মতো তরুণ-যুবকদের জঙ্গি হয়ে ওঠার পুরো প্রক্রিয়াটি জানা সম্ভব হলে হয়তো কিছুটা বোঝা যেত, ভায়োলেন্ট র‍্যাডিক্যালাইজেশনের প্রক্রিয়াটা কীভাবে সম্পন্ন হয়।

জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তবায়ন অবশ্যই দরকার। নিয়মিত পুলিশি অভিযান, নিবিড়তর গোয়েন্দা নজরদারি, গ্রেপ্তার জঙ্গিদের বিচার ও শাস্তি প্রদান—এসবের মাধ্যমে জিরো টলারেন্স নীতির দৃশ্যমান বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। কিন্তু জঙ্গিবাদ নির্মূল করার জন্য এগুলো যথেষ্ট নয়। সমাজের মানুষকেও আরও সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। গ্রাম ও শহরের প্রতিটি পাড়া-মহল্লার মানুষকে জঙ্গিদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে, যেন তারা কোথাও স্থান না পায়, কোনো ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার সুযোগ না পায়। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যে সাধারণ প্রত্যাখ্যান আমাদের সমাজের মানুষের মানসিকতার মধ্যে নিহিত আছে, সেটাকে সচেতন সক্রিয়তায় পরিণত করতে হবে। কোথাও, কোনো বাড়িতে, মসজিদে, মাদ্রাসায়, বিদ্যালয়ে বা অন্য কোনো স্থাপনায় সন্দেহজনক লোকজনের আনাগোনা আঁচ করলেই পুলিশকে খবর দিতে হবে। এভাবে দেশজুড়ে জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর প্রতি সামাজিক সমর্থন-সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন।

এর পাশাপাশি আরও বড় উদ্যোগ নিতে হবে। তা করতে হবে পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রকে; পরিবার থেকে শুরু করে সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সব রাজনৈতিক দল, সংগঠন, সমিতি, সংস্থা, প্রতিষ্ঠানকে। সেটা হলো জঙ্গিবাদ, তথা সব ধরনের চরমপন্থী বা উগ্রপন্থী মনোভাব দূর করার উদ্যোগ। কোনো সমাজে ভিন্ন ভিন্ন মত, দৃষ্টিভঙ্গি, ভাবাদর্শ, ধর্মবিশ্বাসের মানুষের মধ্যে যদি সহিষ্ণুতার অভাব ঘটে, যদি নিজের বিশ্বাস ও ভাবাদর্শকে শ্রেষ্ঠ ভেবে অন্যদের ওপর তা চাপিয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা কাজ করে, তাহলে সেই সমাজে সহিংস উগ্রপন্থা বা জঙ্গিবাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ রকম পরিবেশ যে আমাদের সমাজে একটুও তৈরি হয়নি, তা বলা যাবে না। এখন ধর্মকে আশ্রয় করে যদি সেই উগ্র বা অসহিষ্ণু মনোভাব বেড়ে যায়, তাহলে তরুণ সমাজের জিহাদের নামে সহিংস পন্থা বা জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা বাড়তে পারে।

তাই সবকিছুর আগে প্রয়োজন সহিষ্ণুতার মনোভাব; জীবনের সব ক্ষেত্রে সহিষ্ণুতার চর্চা।

মশিউল আলম (সাংবাদিক)।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ