অ্যামিকাস কিউরিরা কে কী মত দিয়েছিলেন
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল শুনানিতে জ্যেষ্ঠ ১২ আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি (আইনি সহায়তাকারী) হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। ১০ জন আদালতে মতামত উপস্থাপন করেন। তাঁদের মধ্যে নয়জনই সংশোধনীর বিপক্ষে মত দেন। আর পক্ষে মত দেন একজন।
মতামত উপস্থাপন করা ১০ অ্যামিকাস কিউরি হলেন টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, এম আমীর-উল ইসলাম, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, ফিদা এম কামাল, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, এ এফ হাসান আরিফ, এ জে মোহাম্মদ আলী, এম আই ফারুকী ও আজমালুল হোসেন কিউসি। তাঁদের মধ্যে আজমালুল হোসেন কিউসি ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে মত দেন, বাকিরা দেন বিপক্ষে।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল গতকাল সোমবার খারিজ করেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। আপিল শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরিরা কে কী মত দিয়ে ছিলেন, তা পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো:
ষোড়শ সংশোধনী বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মত দেন সংবিধানপ্রণেতা কমিটির অন্যতম সদস্য ড. কামাল হোসেন। ষোড়শ সংশোধনীকে বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় পুরোপুরি সমর্থন করেন জানিয়ে এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হচ্ছে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। আরও কয়েকটি রায়ে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। ষোড়শ সংশোধনী বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খাটো করেছে। ষোড়শ সংশোধনী সংবিধানের মূল কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
টি এইচ খানের লিখিত মত তুলে ধরেন তাঁর ছেলে আইনজীবী আফজাল এইচ খান। লিখিত বক্তব্যে টি এইচ খান বলেন, হাইকোর্ট ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে যে রায় দিয়েছেন, সেটি বহাল রাখাই শ্রেয়। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চাইলে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করা এবং তাদের ক্ষমতা আরও বাড়ানো উচিত।
এম আমীর-উল ইসলাম তাঁর লিখিত বক্তব্যে মত দেন, দুনিয়াজুড়ে যে অবস্থা দেখছেন, তাতে বিচারকদের অসদাচরণের কোনো ঘটনা ঘটলে সেটা আদালতই ঠিক করবে। উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের জন্য একটি জুডিশিয়াল কাঠামো থাকতে হবে। এ জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি।
আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া বলেন, ষোড়শ সংশোধনী সংবিধানের মূল কাঠামোর পরিপন্থী। এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়েছে। অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে থাকলে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো নষ্ট এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের ক্ষমতা প্রধান বিচারপতির হাতে থাকতে হবে। যদি এটা সংসদের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে ভারসাম্য নষ্ট হবে।
ফিদা এম কামাল বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ে এটা এসেছে। সুপ্রিম কোর্টই রায় দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল রেখে দিয়েছেন। এ ব্যবস্থাকে আদালত স্বচ্ছ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বলে উল্লেখ করেছেন।
রোকনউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের কারা অপসারণ করে? পুলিশকে কারা করে? সচিবদের কারা করে? আপনি? সংসদ? কেউ না। তাঁদের অপসারণ করেন তাঁদের ঊর্ধ্বতনেরা। সামরিক বাহিনীর সদস্যদেরটা তাদের ডিসিপ্লিনারিতে আছে। তাহলে আপনাদেরটা (বিচারক) কেন সংসদে যাবে? সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল না থাকলে এখানে (সুপ্রিম কোর্ট) অরাজকতা হবে।’
এ এফ হাসান আরিফ তাঁর মত দিয়ে বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিচারকদের নিজস্ব প্রয়োজনে নয়, বরং জনগণের অধিকার রক্ষার জন্য দরকারি। এর আগে সুপ্রিম কোর্ট বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের একটি অপরিহার্য অংশ বলে রায় দিয়েছেন। ভারতসহ প্রতিবেশী বেশ কয়েকটি দেশে অনেক রায় হয়েছে, যেখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বলা হয়েছে। জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকবে।
এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ রয়েছে। এর কারণে নিজ দলের বিপক্ষে কেউ ভোট দিলে সংসদ সদস্যপদ চলে যায়। এটা থাকার কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে নিজ দলের বিরুদ্ধে মতামত দিতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে কি জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে? হবে না। বিচারক অপসারণের বিষয়েও সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারবেন না। ফলে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে না।
এম আই ফারুকী লিখিত বক্তব্যে বলেন, পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট সামরিক শাসনামলে জারি করা সব ফরমান বাতিল করলেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল ব্যবস্থা রেখে দিয়েছেন। সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীতেও এ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দিয়ে সরকার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী করেছে। ষোড়শ সংশোধনী স্বাধীন বিচার বিভাগ ও গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামোর লঙ্ঘন। বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা তদন্ত হতে হবে বিচারকদের দিয়ে, রাজনীতিবিদদের দিয়ে নয়।
ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে যুক্তি দিয়ে আজমালুল হোসেন কিউসি বলেন, বিচারকেরা জনগণের হয়ে বিচার করছেন। তাঁদেরও জবাবদিহির প্রয়োজন আছে। সংবিধান অনুযায়ী সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। জবাবদিহির জন্য সংসদে যাঁরা নির্বাচিত সংসদ সদস্য, জনগণের যাঁরা প্রতিনিধিত্ব করছেন, তাঁদের কাছে জবাবদিহি থাকার প্রয়োজন আছে। সংসদের হাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা দিয়ে যে সংশোধনী আনা হয়েছে, সেটি কার্যকর সংশোধনী। এ সংশোধনীর মাধ্যমে আদি সংবিধানে ফিরে যাওয়া হয়েছে। এই সংশোধনী অবশ্যই আইনত বৈধ।