জল দূর করার টাকা জলে !
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: সাগর, নদী, বন আর পাহাড়ঘেরা চট্টগ্রামের নাম শুনলে এখন আর প্রকৃতির ‘সুন্দর রূপ’ ভেসে ওঠে না; বরং কল্পনায় ভেসে আসে ‘জলাবদ্ধ’ এক নগরীর ছবি। হাঁটু থেকে কোমরপানি ডিঙিয়ে হাঁটছে মানুষ। ডুবে থাকা রাস্তায় খুব সাবধানে চলছে গাড়ি। এক দশকের বেশি সময় ধরে গণমাধ্যমে চট্টগ্রামের এমন ছবিই প্রাধান্য পেয়েছে। ব্যতিক্রম হয়নি এবারও। ‘ডুবে থাকা’ চট্টগ্রাম নগরীর ছবি এই বর্ষায় আরও কয়েকবার দেখা যাবে, সন্দেহ নেই।
এখন ভরা বর্ষা। প্রতিনিয়ত জলাবদ্ধতার আতঙ্কে থাকে নগরবাসী। বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে এই জনদুর্ভোগ। অথচ নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে গত ১৪ অর্থবছরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তিন মেয়র প্রায় ৩২৪ কোটি টাকা খরচ করেছেন। এই টাকা ব্যয় হয়েছে নালা-নর্দমা ও খাল থেকে মাটি উত্তোলন, প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ, খালের তলা পাকাকরণ, খননযন্ত্র ও মাটি সরানোর কাজে ট্রাক কেনায়। জলাবদ্ধতা দূর করতে প্রতিবছর গড়ে খরচ হয়েছে ২৩ কোটি টাকা।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলীদের মতে, পরিকল্পিতভাবে ওই টাকা খরচ হয়নি। রুটিন কাজ করেই দায় সেরেছে সিটি করপোরেশন। জল দূর করার টাকা যেন জলেই গেছে। ফলে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। আবার সমস্যা যতটা ব্যাপক, সে অনুযায়ী ব্যয় হওয়া অর্থ প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।
এ বছর বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগে গত এপ্রিল মাসে প্রবল বৃষ্টিতে (৪ এপ্রিল ও ২১ এপ্রিল) দুবার ডুবেছে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকা। এরপর গত ৩১ মে বৃষ্টিতে আবার ডুবে যায় নগরীর বড় একটি অংশ। সেদিন থেকে টানা চার দিন (৩ জুন) ডুবে ছিল নগরীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সড়ক আগ্রাবাদ এক্সেস রোড। এরপর ১২ জুন বৃষ্টিতে নগরীর প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা তলিয়ে যায়। ডুবে যায় আগ্রাবাদের একটি হাসপাতালসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকা। তখন আবারও প্রায় তিন দিন ডুবে ছিল আগ্রাবাদ এক্সেস রোড। এ সময় সড়কে নৌকাও চলতে দেখা যায়। সর্বশেষ ৩ জুলাই প্রবল বৃষ্টিতে আবারও তলিয়ে যায় নগরী।
চট্টগ্রাম নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের ২২টিতেই বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে কমবেশি জলাবদ্ধতা হয়। নগরীর ৬০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ৩১ লাখ ২৩ হাজার ৬১৩ জন এসব ওয়ার্ডে বসবাস করছে। সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
সবচেয়ে বেশি জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ পোহাতে হয় চান্দগাঁও, পূর্ব ষোলশহর, শুলকবহর, চকবাজার, পশ্চিম বাকলিয়া, পূর্ব বাকলিয়া, দক্ষিণ বাকলিয়া, উত্তর আগ্রাবাদ, দক্ষিণ আগ্রাবাদ, পাঠানটুলী, বকসিরহাট, গোসাইলডাঙা, উত্তর মধ্যম হালিশহর এলাকার মানুষদের। এই ১৩ ওয়ার্ডে মোট বাসিন্দা ১৮ লাখ ২৮৫ জন।
এ ছাড়া পাঁচলাইশ, মোহরা, পশ্চিম ষোলশহর, উত্তর কাট্টলী, রামপুর, উত্তর হালিশহর, পাথরঘাটা, দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর ও দক্ষিণ হালিশহরের বাসিন্দাদেরও জলাবদ্ধতায় ভুগতে হচ্ছে। এ ৯টি ওয়ার্ডে বাস করে ১৩ লাখ ২৩ হাজার ৩২৮ লোক।
সিটি করপোরেশনের বাজেট বই ও বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকাকালে ২০০৩-০৪ থেকে ২০০৮-০৯ অর্থবছর পর্যন্ত জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যয় হয় ৬৬ কোটি ১১ লাখ টাকা। মহিউদ্দিন চৌধুরীকে পরাজিত করে ২০১০ সালের ১৭ জুনের নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন মোহাম্মদ মনজুর আলম। তাঁর মেয়াদে ব্যয় হয় ২০৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা। বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন দায়িত্ব নিয়ে দুই বছরে খরচ করেছেন ৫২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।
২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন প্রতিশ্রুতি
দিয়ে বলেছিলেন, জলাবদ্ধতা একটি সমাধানযোগ্য সমস্যা। আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে এবং কয়েকটি বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিলে জলাবদ্ধতা থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব। মেয়র নির্বাচিত হয়ে ২০১৫ সালের ২৬ জুলাই দায়িত্ব নেন তিনি। দুই বছর দায়িত্ব পালনের পর মেয়র এখন বলছেন, এ মুহূর্তে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না।
সিটি করপোরেশনের সেই জনবল এবং আর্থিক সক্ষমতাও নেই। এ জন্য মেগা (বড়) প্রকল্প নিতে হবে এবং সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
তবে এই সমস্যা নিরসনের জন্য বসে না থেকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানান মেয়র নাছির উদ্দীন।তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পৃথকভাবে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চলছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকার জলাবদ্ধতার কারণগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।
চট্টগ্রাম নগরীর বৃষ্টির পানিনিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম চাক্তাই খাল। সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর সময় চাক্তাই খালের তলা পাকা এবং দুই পাশে প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ করা হয়। তবে দু-তিন বছরের মধ্যে আবার খাল ভরাট হয়ে যায়। এতে খালের আশপাশের এলাকা চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, বউবাজার, মাস্টারপোল, মিয়াখান নগর, ডিসি রোড, চকবাজার, বাকলিয়া ও কাপাসগোলা এলাকায় আবারও জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে খালের দুই পাড় উপচে তলিয়ে যেত বসতঘর, রাস্তাঘাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে বৃষ্টির সময় জোয়ার হলে এই পরিস্থিত ভয়াবহ আকার ধারণ করত। এই সমস্যা এখনো রয়ে গেছে।
সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, নগরীতে শাখা-প্রশাখাসহ মিলিয়ে ১১৮টি খালের মোট দৈর্ঘ্য ১৮২ দশমিক ২৫ কিলোমিটার। বর্তমানে পাকা ও কাঁচা নালা-নর্দমা আছে যথাক্রমে ৭১০ কিলোমিটার ও ৫৫ কিলোমিটার।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ‘নগর পরিস্থিতি: বাসযোগ্য চট্টগ্রামের জন্য শাসনব্যবস্থা’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কেন্দ্র থেকে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বরাদ্দ পায়। করপোরেশনের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের হার ১৭ থেকে ৩৫ শতাংশে ওঠানামা করে। আর রাজনৈতিক বিবেচনায় কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হয়। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গবেষণাটি প্রকাশ করা হয়।
চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশনের পদক্ষেপকে রুটিন কাজ বলে মন্তব্য করেছেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার। তিনি বলেন, খাল ও নালা-নর্দমা থেকে মাটি উত্তোলন করে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন করা সম্ভব নয়। এ সমস্যা দূর করতে সিটি করপোরেশনের নেতৃত্বে সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করার বিকল্প নেই। আর বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।
সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনজুর আলমের সময় সিটি করপোরেশন নালা-নর্দমা ও প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণে ৮২ কোটি ৮২ লাখ ৯১ হাজার টাকা এবং নালা-নর্দমা ও খাল থেকে মাটি অপসারণে ২১ কোটি ৯৭ লাখ ২৭ হাজার টাকা খরচ হয়।
সাবেক মোহাম্মদ মনজুর আলম বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার সময় খাল খননের জন্য সিটি করপোরেশনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছিল না। তিনি এক্সকাভেটর (খননযন্ত্র), ট্রাকসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কিনেছেন। এ ছাড়া সাত থেকে আট কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর বিভিন্ন খাল থেকে মাটি উত্তোলন করেছেন। এসব উদ্যোগের নেওয়ার কারণে তাঁর সময়ে জলাবদ্ধতা জলজটে নেমে আসে বলে দাবি করেন তিনি।
যখন নাগরিক দুর্ভোগ চরমে ওঠে তখন লোক দেখানোর জন্য সব মেয়রই খাল খননের কাজ শুরু করার পাশাপাশি যন্ত্রপাতি কেনেন বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রামের প্রবীণ অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ সিকান্দার খান। তিনি বলেন, ৩২৪ কোটি অনেক টাকা। এই টাকা পরিকল্পিত উপায়ে খরচ করা হলে নগরবাসী সুফল পেত। গত কয়েক বছরে জলাবদ্ধতা সমস্যার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। এই সমস্যা সমাধান করতে ১৯৯৫ সালে প্রণীত চট্টগ্রাম ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। কেবল জোড়াতালির কাজ করে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
এক নজরে
৬০ লাখ
বাসিন্দা বসবাস করে চট্টগ্রাম নগরে
৪১টি ওয়ার্ড
২২টিতেই বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে জলাবদ্ধতা হয়
৩১,২৩,৬১৩ জন
জলাবদ্ধতার দুর্ভোগের প্রত্যক্ষ শিকার। তারা নগরের ২২টি ওয়ার্ডে বসবাস করে
৬৬.১১ কোটি টাকা জলাবদ্ধতা নিরসনে মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকার সময়ে খরচ করেছেন
২০৫.৫২ কোটি টাকা
জলাবদ্ধতা দূর করতে মেয়র থাকার সময়ে খরচ করেছেন মনজুর আলম
৫২.৫৩ কোটি টাকা
জলাবদ্ধতা দূর করতে গত দুই বছরে খরচ করেছেন আ জ ম নাছির উদ্দীন
সূত্র: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন