আইএস বিশ্বায়নের আরেক সহিংস চেহারা
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: আমরা যে সময়ে বেঁচে আছি, সেটা উত্তুঙ্গ বিশ্বায়নের সময়। প্রবল কানেকটিভিটি মানুষকে ভার্চ্যুয়ালি কাছে এনেছে, সঙ্গে ফাও হিসেবে এনেছে ম্যানুফ্যাকচার্ড হিংসা ও অপরের প্রতি ঘৃণা। ‘মানবজাতি’ নামের ছাতার ছায়াতলে বসে প্রগতি, মানবতা, গণতন্ত্র নানাবিধ যে বেলুনগুলো আমরা ফুলাই, মাঝেমধ্যেই তা ঠুস করে ফেটে যায়, আমরা তৎক্ষণাৎ অস্বস্তিতে পড়ে যাই। আমরা ভুলে যাই, ‘প্রগতি’র যাত্রাপথ কখনোই একরৈখিক ছিল না। আধুনিক গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম যে ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে, সেই বিপ্লব সন্ত্রাসবিহীন ছিল না। জ্যাকোবিনদের নৃশংসতা পরবর্তী যেকোনো বিপ্লবীদের লজ্জা দেবে। ইউরোপীয় গণতন্ত্র, আধুনিকতা, ব্যক্তিস্বাধীনতার নিচে চাপা পড়ে ছিল উপনিবেশের অগণিত মুর্দা। জার্মান নাজিজম বা হলোকাস্ট খুব আগের কথা নয়।
ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের তাত্ত্বিকদের মতে, আধুনিকতার একটা অবশ্যম্ভাবী পরিণতিই ছিল হলোকাস্টের দিকে যাত্রা করা। একটা অ্যাপোক্যালিপ্টিক ডেথ কাল্ট, যা সময়ের শুরুতে ফিরে যেতে চায়, খোদার আরশের নিচে খোদায়ি সাম্রাজ্য কায়েম করতে চায়, এই রকম গোষ্ঠী যুগে যুগে এসেছে। নার্সিসাসকে নিহিলিস্ট হতে হয়। প্রবল আধুনিকতা যে নিহিলিস্ট-নার্সিসাস তৈরি করে, আত্মঘাতী ডেথ কাল্টের জন্ম দেয়, তার প্রমাণ জাপানের ওম শিনরিকিও মুভমেন্ট কিংবা আমেরিকার চার্লস ম্যানসন গোষ্ঠী। আইএস এর সর্বশেষ ও সবচেয়ে ভয়ানক উত্তরাধিকার। আইএস মধ্যযুগীয় নয়, আধুনিকতার উপজাত। বিশ্বায়ন ছাড়া আইএসের জন্ম ও বিস্তার সম্ভব হতো না। ধর্মবাদী সব র্যাডিক্যাল মৌলবাদী আন্দোলনই আধুনিকতার বিপরীতে আধুনিকতার গর্ভেই জন্মলাভ করেছে। মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলে বর্তমানকে নিষ্পাপ দেখানোর যে আধুনিক রাজনীতি, আইএসের জন্মে তারও দায় আছে।
প্যারিস, ব্রাসেলস ও অধুনা ম্যানচেস্টারে আইএসের হামলায় যেসব ‘নিঃসঙ্গ নেকড়ে’ দায়ী, তারা প্রায় সবাই ইউরোপে জন্ম নিয়েছে, সেখানেই বেড়ে উঠেছে। আমরা যে বিশ্বায়নের কথা বলছি, আধুনিকতার কথা বলছি, তার প্রথম বিন্দু যদি পত্রিকা সাম্রাজ্য কিংবা প্রিন্ট ক্যাপিটালিজমকে ধরি, টিভির সর্বগম্যতায় তার বিকাশ এবং আজকের ইন্টারনেটের দুনিয়ায় সে পরিণত ও সার্বভৌম। কল্পিত ‘মুসলিম উম্মা’র ভাই-বেরাদরদের দুঃখে কাতর ও ‘ডিসট্যান্ট সাফারার’ বা দূরবর্তী ভুক্তভোগী এই নেকড়েরা প্রতিদিন নেট ঘেঁটে দেখছে, মুসলমানরা মরছে দূরদূরান্তে। এই মরণোৎসব কেবল প্রত্যক্ষ করা ছাড়া তার কিছুই করার নেই। ম্যানচেস্টারে আত্মঘাতী হামলাকারী সিরিয়ার শিশুদের দুঃখে ব্যথিত ছিল, তার এই দূরবর্তী দুঃখের কোনো রাজনৈতিক সমাধান না পেয়ে ক্রোধ বেঁকে গেছে ভেতরে, নিজস্ব অক্ষমতা বোমা হয়ে ফেটেছে কনসার্টে। এই সুইসাইড সহজ হয়, যখন কোনো বিমূর্ত দৈবসত্তার কারণে সে আত্মোৎসর্গ করে। দুনিয়াবি কোনো প্রতীকের চেয়ে ঐশী প্রতীকের উসকানি দেওয়ার ক্ষমতা বেশি, কারণ জবাবদিহির প্রশ্নটি তাতে ঘোলাটে থাকে। কল্পিত মহত্তর কোনো উদ্দেশ্যে আত্মবলিদান নতুন কোনো ঘটনা বা প্রপঞ্চ নয়। এই নিঃসঙ্গ নেকড়েরা কেউই নিষ্ঠাবান মুসলিম ছিল না, তারা কোনো একটা ঘটনার পরে মুসলমান হয়ে ওঠে এবং তাদের র্যাডিক্যালাইজেশন ঘটে। অনেকে ছিল টিপিক্যাল ফান লাভিং, পার্টি গোয়ার, ভায়োলেন্ট ভিডিও গেমস খেলোয়াড়, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সে অভিযুক্ত ও কপিবুক এড্রিনালিন জাঙ্কি। আইএস তাদের ভায়োলেন্স ফেটিশ চরিতার্থ করার জানালা। এই ঘটনাগুলোকে ‘র্যাডিক্যালাইজেশন অব ইসলাম’ না বলে অনেকে তাই ‘ইসলামাইজেশন অব র্যাডিক্যালস’ বলছেন। ইউরোপে মাল্টিকালচারালিজম ব্যর্থ হচ্ছে কি না জানি না, তবে সমাজে অসংখ্য পকেট তৈরি হয়েছে, যেখানে এমন আগুন তৈরি হচ্ছে।
ইউভাল হারারি বলেন, আইএসের হামলাগুলো একধরনের থিয়েট্রিক্যাল হরর শো প্রদর্শন করতে চায়। তরল ভয়ের যে সংস্কৃতি চালু আছে, সেটাকে উসকে দিতে চায়। আল-কায়েদা যেদিন টুইন টাওয়ারে হামলা করেছিল, সেদিন একই সঙ্গে পেন্টাগনেও হামলা করেছিল। যেকোনো প্রথাগত যোদ্ধা বাহিনীর কাছে পেন্টাগন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে হামলার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে। কিন্তু প্রতীকবাদী যে যুদ্ধ আল-কায়েদা করতে চায়, তাতে প্রতীক হিসেবে টুইন টাওয়ার পেন্টাগনের চেয়ে শক্তিশালী। একটা খাড়া উদ্ধত টাওয়ার, যা আমেরিকার অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের প্রতীক, তার ধসে পড়ার লাইভ দৃশ্য যে পরিমাণ আতঙ্ক উৎপাদন করতে পারে, পেন্টাগনে হামলায় তা সম্ভব না। আরবান গেরিলা ওয়ারফেয়ারের এই পদ্ধতিতে মিলিট্যান্টরা এই পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে নামে যে রাষ্ট্র তাতে ওভাররিয়েক্ট করবে। তা-ই হয়। রাষ্ট্র আরেকটা হরর শো মঞ্চায়ন করে, যেটা অধিকতর নাটকীয়। তারা অপেক্ষায় থাকে পরিস্থিতি ঘোলা হওয়ার, অপেক্ষায় থাকে নৈরাজ্যের। পাবলিক পরিসরকে সহিংসতামুক্ত রাখার যে ওয়াদা আধুনিক রাষ্ট্রের লেজিটিমেসির প্রধান উৎস, তাকে আক্রমণ করতে চায় তারা। এর পরিণামে আমরা দেখি, সন্ত্রাস কমে না, কিন্তু রাষ্ট্র ক্রমে অরওয়েলিয়ান ডিসটোপিয়ার অংশ হয়ে ওঠে।
আইএসের জন্ম হতো না যদি আমেরিকা ইরাকে আগ্রাসন না চালাত। অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম এখন ইরাকিদের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নামান্তর। সাবেক উপনিবেশগুলো, যেগুলোকে জোর করে জাতিরাষ্ট্রের বটিকা এবং ইউরোপীয় রাজনৈতিক সমাজের আদলে একধরনের অন্তর্বর্তীকালীন গণতন্ত্র গেলানো হয়েছে, তারা বমি করে দিচ্ছে সেসব। ফলত নৈরাজ্যের জন্ম হচ্ছে। এটা অনেক পুরোনো পাপ। তার সর্বশেষ সংস্করণে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমেরিকার তেলের লোভ ইরাকিরা, সিরিয়ানরা, লিবিয়ানরা এখন তাদের রক্ত দিয়ে শোধ করছে। আইএস বর্তমানে কোণঠাসা অবস্থায় আছে, তাই যুদ্ধক্ষেত্র বদলে দিয়েছে সে। ইউরোপের বুকের ভেতর সে হরর শো দেখাচ্ছে একের পর এক। তার রিক্রুটমেন্ট টুলস আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর, ফলে যেকোনো অস্থির, অসামাজিক তরুণ রেজিস্টার করতে পারছে সহজেই। আইএস পুরোটাই একটা গ্লোবাল ফেনোমেনা, সে এখন গ্লোবালাইজেশনের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার দায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছে। প্রতিবাদী ‘অকুপাই মুভমেন্ট’ কিংবা ইউরোপের রক্ষণশীল জাগরণ যেখানে বিশ্বায়নবিরোধী, সেখানে আইএস পুরোদস্তুর বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। শ্রেণি-রাজনীতি কিংবা জাতিবাদী রাজনীতি যে গ্লোবালাইজড-শূন্যতায় খাবি খাচ্ছিল, সেখানেই তার উদ্ভব।
লক্ষ করার বিষয়, এই রাজনৈতিক-শূন্যতায় প্রধান খেলোয়াড় হচ্ছে মাল্টিন্যাশনাল করপোরেশনগুলো। আইএসের মতোই বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কোনো রাষ্ট্রীয় সীমানা মানে না, কোনো জবাবদিহিও নেই তাদের। এদের বন্ধু হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প কয়েক দিন আগে কয়েক বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বেচে এলেন তাদের কাছে, যারা ইসলামি সন্ত্রাসবাদের মাতৃভূমি। এই বিশ্বব্যবস্থার অ্যান্টিথিসিস হচ্ছে আইএসের মতো ডেথ কাল্টগুলো, আতঙ্ক যাদের একমাত্র পণ্য। বৈশ্বিক মানবতাবাদী সংস্থাগুলো যেভাবে ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর কথা বলে এবং শুধুই ডোনারদের কাছে দায়বদ্ধ থাকে, আইএস একইভাবে বলে ‘মুসলিম উম্মা’র কথা, কিন্তু তাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডগুলোর সবচেয়ে বড় শিকার হয়ে পড়েছে মুসলিম উম্মাই।
ব্রেক্সিট, ট্রাম্প ও ইউরোপীয় ডানপন্থার পুনর্জাগরণ আমরা দেখছি এখন। লন্ডন-ব্রাসেলস-ম্যানচেস্টার-প্যারিস হামলার পরে তা কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। মারি লা পেনের বাবা এক যুগ আগে ফ্রান্সের ইলেকশনের ফাইনাল রাউন্ডে ১৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন, তার সুযোগ্য কন্যা এবার পেয়েছেন ৩৩ শতাংশ ভোট। এই উল্লম্ফন অপ্রত্যাশিত নয়। ইংল্যান্ডের নির্বাচনেও জয়ী হলো থেরেসা মের রক্ষণশীল সরকার। শ্রেণি-রাজনীতির দুর্বলতায় আত্মপরিচয়ের রাজনীতি পৃথিবীব্যাপী শক্তিশালী হচ্ছে, ঘৃণা দখল করে নিচ্ছে কেন্দ্রীয় মঞ্চ। আপাতত সুড়ঙ্গের শেষে কোনো আলোর নাচন দেখা যাচ্ছে না।
এ টি এম গোলাম কিবরিয়া
অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ব্যাংকার