শত্রুরও যাতে চিকুনগুনিয়া না হয়
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: পৌনে দুই মাস আগে গায়ে কাঁপুনি ধরিয়ে জ্বর আসে কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা হারুন অর রশিদের। প্রথমে ভেবেছিলেন সাধারণ জ্বর। কিন্তু দুদিন পরেই শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। আর জ্বরও কমে না। গায়ে ১০৪-১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা। চিকিৎসকের কাছে যেতেই জ্বরের ধরন দেখে চিকিৎসক বললেন তাঁর চিকুনগুনিয়া হয়েছে।
এই জ্বরের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে হারুন অর রশিদ বলেন, কী যে প্রচণ্ড ব্যথা, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। হাত-পায়ের গিরায় গিরায় ব্যথা। পরে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে রগেও। ঘুম থেকে উঠলে ব্যথায় পায়ের পাতা মাটিতে রাখা যায় না। স্বাভাবিক হতে এক ঘণ্টা সময় লাগে। পৌনে দুই মাস আগে হলেও এখনো ব্যথা আছে। ব্যথা একেক দিন একেক জায়গায়। এখনো ঠিকমতো সেরে উঠিনি।
কাঁঠালবাগান এলাকার আরেক বাসিন্দা মো. সবুজ কাজ করেন একটি বেসরকারি হাসপাতালে। তাঁর হাসপাতালে গত কয়েক দিন ধরে চিকুনগুনিয়ার রোগী আসতে থাকে। এখন তিনি নিজেও এই জ্বরে আক্রান্ত। তিনি বলেন, ‘ঈদের ১০ দিন আগে আমার জ্বর আসে। উপসর্গ দেখেই বুঝেছি আমার চিকুনগুনিয়া হয়েছে। তারপরও নিশ্চিত হতে চিকিৎসকের কাছে যাই। চিকিৎসক জানান, চিকুনগুনিয়া হয়েছে। চিকিৎসক নাপা ট্যাবলেট আর তরল খাবার খেতে পরামর্শ দিয়ে বিশ্রাম নিতে বলেছিলেন। সাত থেকে আট দিন ছুটি কাটানোর পর গতকাল অফিসে যাওয়া শুরু করেছি। কিন্তু বসে থাকতে ভীষণ কষ্ট হয়।’
কল্যাণপুর এলাকার বাসিন্দা সামসুর রহমান এক সপ্তাহ আগে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হন। এই রোগের ভয়াবহতা বোঝাতে তিনি বলেন, এক কথায় অসহ্য যন্ত্রণা। একসঙ্গে জ্বর, পাতলা পায়খানা, বমি, গা ব্যথা, খাবারে অরুচি। এক সপ্তাহে সারা শরীর বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। তিনি বলেন, এত দিন ভোগার পর এখন কিছুটা সুস্থ বোধ করছি। কিন্তু ব্যথা আছে সারা শরীরে।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ফিরোজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাকে এই রোগে অনেক দিন ধরে ভুগতে হচ্ছে। আমার কোনো শত্রুরও যেন এ রোগ না হয়। ভয়ংকর ব্যথা। সহ্য করা যায় না।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) সরকার চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ সোমবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত মানুষ সেখানে এসে রক্ত পরীক্ষা করছে। গুলশান ১ থেকে এসেছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী মো. পলাশ। তিনি বলেন, গত শনিবার থেকে তীব্র ব্যথা আর জ্বর। টেলিভিশনে দেখলাম এখানে বিনা মূল্যে রক্ত পরীক্ষা করা হয়। তাই এখানে এসেছি। কর্তব্যরত এক চিকিৎসক জানালেন, এখানে নিয়মিত চিকুনগুনিয়ার পরীক্ষা করা হচ্ছে। তিনি জানালেন, এ পর্যন্ত মুঠোফোনের হট লাইনের মাধ্যমে ৪৮১ জনকে সেবা দেওয়া হয়েছে।
গ্রিন রোডের ওষুধ ফার্মেসি মেডিসিন ওয়ার্ল্ডের বিক্রেতা মো. সারওয়ার বলেন, গত দেড় মাসে প্রতিদিন অন্তত ১৫ থেকে ২০ জন চিকুনগুনিয়ার রোগী ওষুধ কিনতে এসেছে। তবে ইদানীং কিছুটা কমেছে।
চিকুনগুনিয়ার রোগের লক্ষণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, এ রোগের মূল উপসর্গ হলো জ্বর এবং অস্থিসন্ধির ব্যথা। শরীরের তাপমাত্রা অনেকটা বেড়ে প্রায়ই ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে যায়, তবে কাঁপুনি বা ঘাম দেয় না। জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখ জ্বালা, গায়ে লাল লাল দানার মতো র্যাশ, অবসাদ, অনিদ্রা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা হয়, এমনকি ফুলেও যেতে পারে। তীব্র অবসাদ, পেশিতে ব্যথা, অস্থিসন্ধির ব্যথা ইত্যাদি জ্বর চলে যাওয়ার পরও কয়েক সপ্তাহ থাকতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, এমনকি মাসের পর মাসও অস্থিসন্ধিতে ব্যথা বা প্রদাহ থাকতে পারে; যা অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে স্বাভাবিক কাজ করতে অক্ষম করে তোলে। রোগী ব্যথায় এতই কাতর হন যে হাঁটতে কষ্ট হয়, সামনে বেঁকে হাঁটেন।
রোগের চিকিৎসার কথা বলতে গিয়ে এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, অন্যান্য ভাইরাস জ্বরের মতো এই রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। এর চিকিৎসা মূলত রোগের উপসর্গগুলো নিরাময় করা। রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে এবং প্রচুর পানি বা অন্যান্য তরল খেতে দিতে হবে। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধই যথেষ্ট। এর সঙ্গে সঙ্গে পানি দিয়ে শরীর মুছিয়ে দিতে হবে। তীব্র ব্যথার জন্য অন্য ভালো ওষুধ প্রয়োজন হতে পারে। রোগীকে আবার যেন মশা না কামড়ায়, এ জন্য তাঁকে মশারির ভেতরে রাখাই ভালো। কারণ, আক্রান্ত রোগীকে মশা কামড় দিয়ে কোনো সুস্থ লোককে সেই মশা কামড়ালে ওই ব্যক্তিও এ রোগে আক্রান্ত হবেন।
প্রতিরোধের কথা বলতে গিয়ে এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, চিকুনগুনিয়া জ্বরের কোনো প্রতিষেধক নেই, কোনো ভ্যাকসিন বা টিকাও নেই। তাই রোগ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো এডিস মশা প্রতিরোধ। এডিস মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করা এবং মশা নির্মূল করাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। বাসাবাড়ির আশপাশে যেখানে পানি জমে থাকতে পারে, তা সরিয়ে ফেলতে হবে এবং নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। ডাবের খোসা, কোমল পানীয়ের ক্যান, ফুলের টব—এসব স্থানে যাতে পানি জমে না থাকে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। দরজা-জানালায় নেট লাগানো, ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার। জেনে রাখা ভালো, এডিস মশা মূলত দিনের বেলা এবং ঘরের বাইরেই বেশি কামড়ায়।