চরমপন্থীরা ভিড়ছে আ. লীগে
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: খুলনায় চরমপন্থী দলের সদস্য হিসেবে তালিকাভুক্ত অনেকে আওয়ামী লীগে যুক্ত হচ্ছেন। ইতিমধ্যে কেউ কেউ দলের পদ পেয়েছেন এবং দলের প্রার্থী হিসেবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, চরমপন্থী দলের এসব সদস্যকে ক্ষমতাসীন দলে ভেড়ানোর ক্ষেত্রে প্রতিমন্ত্রী, সাংসদ বা এলাকাভিত্তিক দলীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। চরমপন্থীদের এভাবে দলে অন্তর্ভুক্ত করায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের একটি বড় অংশ বিব্রত। এ নিয়ে তাঁরা একে অপরকে দোষারোপ করছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চরমপন্থী দলের একসময়কার নেতা শিপলু ভূঁইয়া এখন খুলনার ফুলতলা উপজেলার দামোদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান। তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় তাঁর পরিচয় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (জনযুদ্ধ) খুলনার আঞ্চলিক নেতা।
চরমপন্থীদের নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার ওই তালিকার ৩ নম্বরে রয়েছে শিপলু ভূঁইয়ার নাম। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ প্রায় এক ডজন মামলা রয়েছে। একটি মামলায়তাঁর ৩২ বছরের সাজাও হয়েছে। শিপলুর বড় ভাই শিমুল ভূঁইয়ার নামও রয়েছে ওই তালিকার ৪ নম্বরে। শিমুল বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির (বরুণ গ্রুপ) আঞ্চলিক নেতা। তাঁর বিরুদ্ধেও হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ ডজনখানেক মামলা রয়েছে। তিনি এখন পলাতক।
শিপলু ভূঁইয়া দাবি করেন, তাঁর ভাই শিমুল ভূঁইয়া চরমপন্থী দলে জড়িত ছিলেন। তাঁকেও চরমপন্থী দলে নেওয়ার চেষ্টা করলেও তিনি যাননি। তিনি বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মোস্তফা রশিদী তাঁকে সরকারি দলে নিয়েছেন।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, ২০১৪ সালের ১১ নভেম্বর শিপলু ভূঁইয়া ফুলতলা উপজেলায় অনুষ্ঠিত যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে যুবলীগে যোগদান করেন। ওই সময় তাঁকে দলে ভেড়াতে সহযোগিতা করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ আকরাম হোসেন। শিপলু ২০১৬ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে দামোদর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন এবং বিজয়ী হন। তাঁকে জেতানোর ক্ষেত্রে শেখ আকরাম হোসেন বড় ভূমিকা পালন করেন বলে অভিযোগ আছে।
শেখ আকরাম হোসেন বলেন, ‘শিপলু নির্দোষ না থাকলে আমরা দলে নিতাম না। দামোদর ইউনিয়নে ৩২ বছরে আওয়ামী লীগের কেউ চেয়ারম্যান হয়নি। শিপলুকে দলে নেওয়ার পরই এটা সম্ভব হয়েছে। তবে তার ভাই শিমুল ভূঁইয়া চরমপন্থী বলে আমরা জানি।’
পুলিশ বলছে, সম্প্রতি খুলনায় যেসব খুনের ঘটনা ঘটছে, তাতে চরমপন্থীদের যুক্ত থাকার প্রমাণ মিলছে। গত ২৭ মে রাতে খুলনা জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফুলতলা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সরদার আলাউদ্দীন ওরফে মিঠু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শিপলুর ভাই শিমুলের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। ফুলতলা উপজেলার তালিকাভুক্ত চরমপন্থী দলের ১০ থেকে ১৫ জন শিপলুর সঙ্গে আছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে।
চরমপন্থীরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে—এ কথা স্বীকার করে খুলনা সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘শিমুল ভূঁইয়া যে আওয়ামী লীগের ছত্রচ্ছয়ায় আছে, তা বলাই যায়, যেহেতু তার ভাই আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান।’
ডুমুরিয়া উপজেলার চরমপন্থীদের তালিকার ২১ নম্বরে আছে অজয় সরকারের নাম। তিনি নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। মনোনয়ন না পাওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচন করেন। আগামী সংসদ নির্বাচনে খুলনা-৫ (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) অথবা খুলনা-৬ (পাইকগাছা-কয়রা) আসনে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ দুই এলাকায় আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচারণাও চালাচ্ছেন। তিনি মোস্তফা রশিদীর ছত্রচ্ছায়ায় থাকেন বলে একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
অজয় সরকার বলেন, ‘২০০৩-০৪ সাল থেকে আমাকে চরমপন্থী বলা হচ্ছে। আসলে আমি সেভাবে কখনো জড়িত ছিলাম না। জামায়াত এই প্রচার করছে।’ তিনি বলেন, মোস্তফা রশিদীর সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক রয়েছে।
তবে মোস্তফা রশিদী দাবি করেন, ‘শিপলু ভূঁইয়া দলে যোগদান করেছেন, সেটা তো আমি জানিই না। অজয় সরকারের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এঁরাসহ অনেকেই দলে ঢুকেছেন, এটা ঠিক। রূপসার বাদশা, তেরখাদার মাশিকুল, সাধন—এঁরা সবাই দলে ঢুকে নানা নির্বাচন করছেন। এঁরা সবাই চরমপন্থী।’
চরমপন্থীদের তালিকার ১০ নম্বরে আছে রফিক জোয়ার্দ্দারের নাম। তিনি এখন রুদাঘরা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ওই তালিকার ১২ নম্বরে থাকা শফিকুল ইসলাম এখন উপজেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক। রফিক জোয়ার্দ্দার বলেন, ‘একসময় চরমপন্থী ছিলাম, জেলও খেটেছি। এখন আর এসব করি না।’
খুলনা নগরীর দৌলতপুর দেয়ানা এলাকার গাজী কামরুল ইসলাম নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতা। তিনি হত্যাসহ বেশ কয়েকটি মামলার আসামি। দীর্ঘদিন জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে এখন নিজ বাড়িতে থাকেন। গাজী কামরুল সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী এবং খুলনা-৩ আসনের সাংসদ মন্নুজান সুফিয়ানের আশীর্বাদপুষ্ট বলে এলাকায় প্রচার আছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ হারুন অর রশীদ চরমপন্থীদের আওয়ামী লীগে ভেড়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, ‘জেলায় নয়, নগর আওয়ামী লীগে এমন হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আমরাও আতঙ্কিত।’
নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি নগরে নতুন লোক দলে ঢুকাইনি, তবে জেলায় কিছু ঢুকতে পারে। প্রধানমন্ত্রী আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন খারাপ লোকদের দলে না নিতে।’
চরমপন্থী দলের কয়েকজনকে দলে ভেড়ানোর বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দকে দায়ী করেন শেখ হারুন অর রশীদ। এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘চরমপন্থী যারা দলে ঢুকছে, তারা দলীয় কমিটির সুপারিশ নিয়েই ঢুকছে। শিপলু ভূঁইয়াকে দলে ফুলতলা উপজেলার সভাপতি আকরাম ঢুকিয়েছে।’
‘কিন্তু শিপলু তো আপনার হাতে ফুল দিয়ে দলে যোগ দিয়েছে’—এর জবাবে নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘আমাকে না জানিয়ে ফুল দেওয়া হয়েছে।’
চরমপন্থীরা এভাবে ক্ষমতাসীন দলে ঢুকে পড়ায় বিএনপিও আতঙ্কিত। নগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘চরমপন্থীরা জেল থেকে বের হয়ে দলে দলে আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছে। সাংসদের গাড়িতে ও বাড়িতে তাদের দেখা যাচ্ছে। আমরা আতঙ্কিত যে এদের দ্বারা যেকোনো সময় বড় কোনো ঘটনা ঘটতে পারে।’
চরমপন্থীদের রাজনৈতিক দলে যোগদানের ব্যাপারে জানতে চাইলে খুলনার পুলিশ সুপার নিযামুল হক মোল্লা বলেন, ‘নানা লেবাসে নানাজন ঢুকে পড়ছে। তবে আমরা সচেষ্ট আছি।’