ধস কেবল পাহাড়ে না সবকিছুতেই
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: জল পড়ে পাতা নড়ে আর পোকার মতো মানুষ মরে। এবারে পাহাড় ধসল কক্সবাজারে। মৃতের সংখ্যা সাংবাদিকেরা ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন: এখন পর্যন্ত চারজন, যার দুজন শিশু।
আমাদের বাদল কিন্তু টুটছে না। বাদলের এই অব্যাহত ধারায় কেবল পাহাড়ই ধসছে না, নদীও ভাঙছে।
পাহাড়ধসের আগাম সতর্কবার্তা আমাদের ছিল। তারপরও রাঙামাটির পর বান্দরবানে, সিতাকুণ্ডে এবং এবার কক্সবাজারে পাহাড়ধসে মানুষ মারা গেল। মানুষ কোথায় যাবে? কোনো আশ্রয়কেন্দ্র রাঙামাটিতে ছিল না, কিন্তু কক্সবাজারে তো ছিল। প্রশাসন বলবে, আমরা তো মাইকিং করেছি! কেবল মাইকিং করলে হবে না, মানুষকে যাওয়ার জায়গা দেখাতে হবে, ভরসা জাগাতে হবে। এ বছর আরও বৃষ্টি হবে, আশঙ্কা আছে আরও মৃত্যুর। কিন্তু এত মৃত্যুর বিনিময়ে আমরা কি কিছু শিখলাম?
এমন বৃষ্টি তো আগেও হয়েছে; কিন্তু বিপর্যয় এবার বেশি কেন? একই বৃষ্টি আসাম-ত্রিপুরা-আরাকানেও হয়েছে। কিন্তু সেখানে তো পাহাড় লুটিয়ে পড়ার ঘটনা নেই। একযাত্রায় বিপরীত ফল হলো কী করে? আমাদের চট্টগ্রামের আরাকান রেঞ্জের পাহাড় আর মেঘালয় রেঞ্জের পাহাড়—দুটিই তো মাটির পাহাড়। তা ছাড়া আসামে গত ১৫ বছরের মধ্যে বড় বন্যা হয়েছে। সেখানে বন্যার কারণে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি হয়েছে, তা গত ৪০ বছরের মধ্যে হয়নি। একই রেঞ্জের পাহাড়, একই ধরনের বৃষ্টি, একই গঠনপ্রকৃতি ও একই সময়কাল হওয়া সত্ত্বেও কোন জাদুবলে তাদের পাহাড় লুটিয়ে পড়ছে না? কামরূপ-কামাখ্যার মানুষ কি পাহাড়কে জাদু করেছে?
তারা পাহাড়ের বশীভূত হয়ে বাস করে। আমরা উল্টো পাহাড়কে বশ করতে যাচ্ছি। ভুল জায়গায় রাস্তা বানানো হচ্ছে, স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। দখলের জন্যও বিপজ্জনক জায়গায় ভুল নিয়মে বসতি করানো হচ্ছে। কিন্তু তাতে কী লাভ, সব যদি এভাবে ধসে পড়ে আর অকাতরে মানুষ মরে? রাঙামাটির ধসের পর সেসব রাস্তা আজও চালু করা যায়নি। যাঁরা পাহাড়ে তথাকথিত উন্নয়নকাজ করছেন, তাঁরা পাহাড়ের অস্থিতিশীল করেছেন। এই ধসের পর ওসব এলাকার মানুষের জীবনজীবিকার সংকটও বাড়বে। তাহলে কী লাভ এ ধরনের উন্নয়নে?
যদি জীবন বাঁচাতে চাই, তাহলে আগামী ভাদ্র পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে মানুষকে সরাতে হবে। আর যদি মনে করি, গরিব মানুষ মরতেই থাকবে, তাহলে অন্য কথা। আজকে রাতে সর্বোচ্চ জোয়ার হবে, প্রায় ১০ ফুট উঁচু জোয়ার আসবে। গত ১৫ বছরের মধ্যে এবার অস্বাভাবিক সব প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মাত্রই গতকাল অমাবস্যা গেল, এখন আবার এমন জোয়ার। বাঁশখালী, কুতুবদিয়া, উখিয়ার অরক্ষিত অঞ্চল আজ রাত ও কাল সকালে জোয়ারের হুমকি থাকবে। বড় জোয়ারে উপকূলীয় বাঁধ উপচে পানি আসবে। এখনই মানুষকে সতর্ক করা, আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু করতে হবে। ওই সব এলাকার মানুষকে জানাতে হবে, ভাদ্র মাসের পূর্ণিমায় বড় জোয়ার হয়। তাতে অনেকের আমন ধান ডুবে যাবে। জোয়ার চলে গেলে আবার তাদের সেগুলো লাগাতে হবে। বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়া পর্যন্ত ভাঙনপ্রবণ এলাকা থেকে মানুষকে সরাতে হবে। দুই মাস নরম এলাকা এবং ভাঙনের ইতিহাস আছে, এমন এলাকার মানুষকে সাবধান থাকতে হবে।
ভাদ্র মাসে যখন বড় জোয়ার হবে, তখন যদি পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার পানি একসঙ্গে বাড়ে, তাহলে বড় বন্যা হবে। ১৯৮৮ সালে তেমনটা হয়েছিল। এবারের জোয়ারের প্রবণতা অন্য রকম। এবার ভাদ্র মাস আসার আগেই শ্রাবণ মাসেই বড় জোয়ার হচ্ছে। কিছু একটা অস্বাভাবিক চলন দেখা যাচ্ছে নদীর। এবার নদী পাড় ভাঙছে বেশি। সাধারণত আসামে যখন বড় বন্যা হয়, তার ধাক্কা আমাদেরও খুব সামলাতে হয়। এটাই বিগত বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এবার আসামে বড় বন্যা হলেও আমাদের এখনো তত বিপদ হয়নি। আমাদের কাছে হয়তো যথেষ্ঠ তথ্য নেই, হয়তো সেখানে তারা পানি সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তা যদি হয়, তাহলে গ্রীষ্মকালে আমরা আরেক সমস্যায় পড়ব। আবার তারা যদি বন্যার ধরে রাখা পানি ভাদ্রের বড় জোয়ারের সময় ছাড়ে, তাহলেও বিপদ হবে। অমাবস্যার জোয়ারের সময় বন্যার পানি নামতে পারবে না। পরের অমাবস্যার তারিখ ২২ আগস্ট; সে সময়টায় হুঁশিয়ার থাকা চাই। অথচ বিপদের পর বিপদ আসে, আমরা শিখি না। পরের বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে আগের বিপদের কথা ভুলে যাই।
আসলে এটা শুধু পাহাড়ধস না, ব্যবস্থাপনার ধস, গভর্নেন্সের ধস। পরিকল্পনা ও মানসিকতার ধস। এই সার্বিক ধসের দৃশ্যমান রূপ হলো পাহাড়ধস। এটাই দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের মধ্যে। নদীর মতো পাহাড়ও কিন্তু জীবন্ত। আমরা মানুষের অধিকার যেমন মানিনি, যুগ যুগ ধরে যারা পাহাড়ের বসবাস করে, তাদের কথা ভাবিনি। তেমনি আমরা নদী-পাহাড়-অরণ্যের অধিকারও মানিনি। এই ধসই আমরা বন্যা ও নদীভাঙনের মধ্যে দেখতে পাই, পাহাড়েও দেখতে পাই।
আমাদের মানসিকতার ধস রোখা সম্ভব, এর জন্য মানসিকতা বদলাতে হবে। এর জন্য টাকা লাগবে না।
লেখক : ব্র্যাকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির পরিচালক