উচ্চ মাধ্যমিকের ফল অস্বাভাবিক কি ?
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা:এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় গড় পাশের হার গত বছরের ৭৪.৭০% থেকে ৫.৭৯ ভাগ কমে হয়েছে ৬৮.৯১ শতাংশ। কমে গেছে মোট জিপিএ প্রাপ্তদের সংখ্যাও। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৭ হাজার ৯৬৯ জন। গত বছর জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৫৮ হাজার ২৭৬ জন। গত বছরের চেয়ে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০ হাজার ৩০৭ জন (প্রায়৩৫%) কমে গেছে।
২০১৪ সালের উচ্চ মাধ্যমিকে দেশে গড় পাশের হার ছিল ৭৫.৭৪% যা পরের বছর (২০১৫) সালে নেমে যায় ৬৫.৮৪ শতাংশে। সেখান থেকে ২০১৬ সালে পাসের হার এক লাফে বেড়ে হয় ৭৪.৭০ শতাংশ।
শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘সঠিক মূল্যায়নের ফলে এবার পাশের হার কমেছে।’ আর ফলপ্রকাশের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘লেখাপড়া শিখে মানুষের মত মানুষ হওয়াই গুরুত্বপূর্ণ; পরীক্ষার পাশের হার বিবেচ্য নয়।’
এবার কুমিল্লা বোর্ডে পাস করেছে মাত্র ৪৯.৫২ শতাংশ পরীক্ষার্থী। এই হার দেশে সর্বনিম্ন। উচ্চ মাধ্যমিক ফল প্রকাশের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী কুমিল্লা বোর্ডের ফলাফলে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং ‘ফল কেন খারাপ হল’ তা জানতে চেয়েছেন।
এ বছর যশোর বোর্ডের ফলও খুব ভাল হয় নি। পাশের হার ৭০.৩০ শতাংশ। গত বছর ছিল ৮৩.৪২ শতাংশ। প্রথম আলো শিরোনাম করেছে, ‘ইংরেজি ঝড়ে লন্ডভন্ড যশোর বোর্ড’। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাধবচন্দ্র রুদ্র জানিয়েছেন, ‘ইংরেজিতে মাত্র ৭২.৯৪ শতাংশ পরীক্ষার্থী পাশ করায় ফলাফলে এই বিপর্যয়। গতবার ইংরেজিতে পাশ করেছিল ৯২ ভাগ।’ তারপরও ২০১৫ সালের তুলনায় এবারের যশোর বোর্ডের ফল অনেক ভাল। সে বছর পাশ করেছিল মাত্র ৪৪.৪৫% পরীক্ষার্থী। জিপিএ-৫ প্রাপ্তিও এ বছর কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ বছর যশোর বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ হাজার ৪৪৭ জন পরীক্ষার্থী। এ সংখ্যা গত বছর ছিল ৪ হাজার ৫৮৬।
পাবলিক পরীক্ষায় পাশের উচ্চ হার নিয়ে সমালোচনার অন্ত নেই। অনেকের মতে, পাশের হার যতই বেশি হোক শিক্ষার মান নিম্নমুখী। কেউ কেউ মনে করেন, এদেশে পাশের হারে যে বন্যা চলছে তার সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই। কোন দক্ষতা ছাড়াই লাখ লাখ ছেলেমেয়ে শুধু পাশই করছে না, তাদের জিপিএ এত উঁচু যে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
গত কয়েক বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সামগ্রিক ফলাফলে অসামঞ্জস্য তেমন প্রকট নয়। ২০১২ সালে ৭৮.৬৭, ২০১৩ সালে ৭৪.৩০, ২০১৪ সালে ৭৫.৭৪, ২০১৫ সালে ৬৯.৬০, ২০১৬ সালে ৭৪.৭০ এবং এ বছর ২০১৭ সালে ৬৮.৯১ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে সর্বোচ্চ গড় পাশের হার ছিল ২০১৫ সালে ৭৫.৭৪% এবং সর্বনিম্ন এ বছর ৬৮.৯১ শতাংশ। কিন্তু প্রতি বছর কোন না কোন বোর্ড অস্বাভাবিক খারাপ করায় অন্যান্য বোর্ডের গড় ফলাফলের উপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ২০১৫ সালে এমন অস্বাভাবিক ফল করেছিল যশোর বোর্ড, এবছর করেছে কুমিল্লা বোর্ড।
আবার বোর্ডগুলোর ফলাফলে তেমন সামঞ্জস্য দেখা যায় না। এ বছর সিলেট বোর্ডে পাশের হার সর্বোচ্চ ৭২.০০%। সেখানে কুমিল্লা বোর্ডে পাশের হার মাত্র ৪৯.৫২%, যা খুবই বিষদৃশ। আবার একই বোর্ডের ফলাফলে উত্থান-পতনও কারো নজর এড়াবে না। যেমন, যশোর বোর্ডে ২০১৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে পাশ করেছিল মাত্র ৪৬.৪৫%। কিন্তু পরের বছরই (২০১৬) এক লাফে তা ৩৬.৯৭% বেড়ে হয়ে যায় ৮৩.৪২%। আর ২০১৭ সালে সেখান থেকে ১৩.১২% কমে আসল ৭০.৩০শতাংশে। এ সব তথ্য বিশ্লেষণ করলে অবাক হতেই হয়। অন্যদিকে, গত সাত-আট বছর ধরে রাজশাহী বোর্ডে পাশের অতি উচ্চ হারও খুব বিশ্বাসযোগ্য বলে গণ্য হয়নি। এবারে রাজশাহী বোর্ডে পাসের হার গত সাত বছরে সর্বনিম্ন (৭১.৩০) হলেও তা গড় পাসের হারের (৬৮.৯১) চেয়ে (২.৩১%) বেশিই আছে।
দীর্ঘকাল ধরে পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে তাই সমালোচনার অন্ত নেই। শিক্ষামন্ত্রী যখন বলেন, “সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে বলেই এবার পাশের কিছুটা কমে গেছে” তখন দুটো প্রশ্ন উঠে আসে। এক, তাহলে নিশ্চয় পূর্বের সঠিক মূল্যায়ন হত না। আর এবার যদি সঠিক মূল্যায়ন হয়েই থাকবে, তাহলে বোর্ডগুলোর মধ্যে পাসের হারে এত পার্থক্য কেন?
যশোর বোর্ডে ইংরেজির মতই বিজ্ঞানে পদার্থবিদ্যা ও উচ্চতর গণিতে আশানুরূপ ফল নাকি হয় নি। এম এম কলেজের অধ্যক্ষ বলেছেন, তিনি এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের কাছে জবাব চাইবেন।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৫ সালে যশোর বোর্ডে পাশের হার ছিল মাত্র ৪৬.৪৫ শতাংশ। সে তুলনায় এবার যশোর বোর্ডে ফল নিশ্চয় খারাপ নয়। আবার ২০১৫ সালে যশোর বোর্ডের তুলনায় কুমিল্লা বোর্ডও এবার তত খারাপ করেছে তা বলা যাবে না।
কারো কারো মতে বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে সংখ্যাগত অর্জন গুণগত অর্জনের দিকেই নিয়ে যাবে। উন্নয়নে আনুভূমিক ও ঊর্ধমুখি উন্নয়ন ঠিক সমান তালে চলে না। উন্নয়নের একটি পর্যায় পর্যন্ত সংখ্যাগত উন্নতি যত দ্রুত অর্জিত হয়, গুণগত উন্নতি তা হয় না। তাই সারা দুনিয়ায় উন্নয়নের টেক অফ পর্যায় পর্যন্ত এ ধরনের অসাফল্য থেকেই যায়। এমনকি, ধনী ও উন্নত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ১৯৬৪ সালের পর থেকে স্টান্ডার্ড টেস্টের ফলাফলে দেখা যায় কলেজ গ্রাজুয়েটদের মৌখিক পরীক্ষার দক্ষতা ক্রমাবনতিশীল ছিল। নানা রকম সমস্যায় শিক্ষাব্যবস্থা ছিল জেরবার। ১৯৮০-এর দশকে এসোসিয়েশন অব আমেরিকান কলেজেস (এএসি) জ্ঞানের কতিপয় বিষয়কে সবার জন্য আবশ্যিক এবং ঐচ্ছিক বিষয়ের সংখ্যা কমিয়ে আনার প্রস্তাব করে। একে সংজ্ঞায়িত করা হয় ‘কোর কারিকুলাম’ বলে। এই কোর কারিকুলামে বিষয়গুলোর মধ্যে বিজ্ঞানসহ এমন বিষয়ও রাখা হল যা ছাত্রদের সাংস্কৃতিক বিভিন্নতা সম্পর্কেও জ্ঞান দিতে পারে। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব এডুকেশনও (এনআইই) একই সুরে কলেজ পাঠ্যক্রমের অধিকতর মোক্ষলাভমুখি (পেশা সম্পর্কিত) হয়ে পড়ার বিপদ সম্পর্কে সাবধান করে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারে সমাজে সকল অংশীজনের ভূমিকাকে কঠোর সমালোচনা করা হয়। ১৯৮০ সালের আদম শুমারি মার্কিননীদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যদিও শতকরা ৯৯ ভাগ মার্কিনীই লিখতে ও পড়তে পারে তবু যাদের বয়স ১৭ বছর পর্যন্ত এমন মার্কিনীদের শতকরা ১৩ জনই কার্যত ‘নিরক্ষর’ অর্থাৎ তারা চাকরির দরখাস্তও ভালোভাবে পূরণ করতে পারে না। অথচ এগুলি দৈনন্দিন জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিত্রটি ছিল খুবই হতাশাব্যঞ্জক।
এমন পরিস্থিতিতে পত্র-পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়। পাবলিশারদের বিরুদ্ধে সহজ থেকে সহজতর বই ছাপানোর অভিযোগ থেকে শুরু করে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সমাজের সকলের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করা হলো। প্রশ্নপত্রের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠল পরীক্ষকদের বিরুদ্ধে; ছাত্রদের মোটেই অনুপ্রাণিত করে না এমন অনুষ্ঠান সম্প্রচারের অভিযোগ উঠল টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বিরুদ্ধে; স্কুলে শিক্ষকদের ভাল বেতন না দেবার অভিযোগ করা হল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ইত্যাদি। ঠিক যেন আজকের বাংলাদেশের মত অবস্থা। এর জন্য তারা অহর্নিশ পদ্ধতি পরিবর্তন করে নি। বরং নানা পর্যালোচনার মাধ্যমে সংকট উত্তরণের চেষ্টা করে সফল হয়।
আমাদের দেশে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আছে, আছে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের ন্যূনতম বরাদ্দ না দেবার অভিযোগও। আমাদের সিলাবাস-কারিকুলাম নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। বেআইনি কোচিং বাণিজ্য তো আছেই, এমনকি বাণিজ্যিক লাভালাভে পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেশ ছেয়ে গেছে। শিক্ষায় দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, রাজনীতিক, লেখক, প্রকাশক, গণমাধ্যম, প্রশাসন কিছুই সমালোচনার ঊর্ধে নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা বোর্ড, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সকল প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা মিলে আজকের এই অধঃপতন। আমাদের জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, বিজ্ঞানমনস্ক, দক্ষ জনসম্পদ গড়ে তোলার স্বপ্ন, প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্যমী সমাজ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা তাই প্রতিনিয়ত হোচট খাচ্ছে। সৎ, নিষ্ঠা ও আদর্শসমাজ গঠন এবং সমাজে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা সে কারণেই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আমিরুল আলম খান
সাবেক চেয়ারম্যান, যশোর শিক্ষা বোর্ড