ঢাকার জলাবদ্ধতার দায় এড়ায় যারা
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: বাংলাদেশের রাজধানীটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ, কিন্তু অপরিকল্পিত এক নগরী। মানুষের চেয়ে ক্রমশ তা মশার বাসোপযোগী জলাবদ্ধ নগরীতে পরিণত হয়েছে। যদিও এর পরিকল্পনার জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আছে। আছে দুটি সিটি করপোরেশন। আছে ওয়াসা ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে তাদের কাজ দেখতে পাওয়া যায় না। যা দেখা যায় তা হলো, নগরীর যেখানে-সেখানে বসতবাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান আর বস্তি। দেখা যায়, রাস্তা ও ফ্লাইওভার নির্মাণের কর্মযজ্ঞ আর খোঁড়াখুঁড়ি। দেখা যায় যেখানে-সেখানে ছড়ানো আর স্তূপীকৃত ময়লা। দেখা যায় ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত পয়ো ও শিল্পবর্জ্যের প্রবহমান নালা। ঢাকা নগরীর বাসিন্দাদের কাছে যানজট ও ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধ প্রায় সহনীয় হয়ে গেছে। তবে ঢাকা নগরীর আশপাশের নদীর মাছ ও অন্য জীবগুলো দূষণের নাগপাশে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, ভাঙার গাছপালা, পশুপাখিও প্রায় উধাও হতে বসেছে। উন্নয়নের জোয়ারে ভাসা নগরীর সব জাতের মানুষই বিপদে পড়ে, যখন আকাশ থেকে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়। তখন এই নগরীর পয়োবর্জ্য আর শিল্প বর্জ্য মেশা ময়লা পানি রাস্তায় ও গলি উপচে বাড়ির ভেতরে ঢোকে। ঢাকার সড়কগুলো হয়ে যায় নদী। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৬ বছর, কিন্তু ঢাকা নগরীর পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও দূষণ নিয়ন্ত্রণের কিছু হলো না, বরং নিষ্কাশনের পথগুলো বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধ নগরীতে পরিণত হয়েছে।
ঢাকা নগরীর সুপেয় পানি সরবরাহ ও পয়োবর্জ্য সংগ্রহ ও শোধনের দায়িত্বে ঢাকা ওয়াসার। ‘পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন ১৯৯৬’-এর মাধ্যমে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা আধুনিকীকরণ করা হয় এবং বাজার থেকে বিশেষভাবে দক্ষ ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনা হয়। অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তি এই পদে কাজ করে গেছেন, এখনো করছেন। এই আইনের পর ২০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, পরিস্থিতির উন্নতি নয় বরং অবনতি হয়েছে। ‘পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন ১৯৯৬’ অনুযায়ী ১৭ (২) ধারায় এই কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব বলা হয়েছে, ‘কর্তৃপক্ষ উহার এখতিয়ারাধীন এলাকা বা এলাকার কোন অংশ বিশেষের জন্য নিম্নলিখিত সকল বা যেকোনো বিষয়ে এক বা একাধিক স্কিম প্রণয়ন করিতে পারিবে, যথা: (ক) সুপেয় পানি সংগ্রহ, শোধন, পাম্পিং, সঞ্চয় এবং সরবরাহের জন্য সরবরাহ ব্যবস্থা নির্মাণ, উন্নয়ন ও সংরক্ষণ; (খ) স্বাস্থ্য- পয়ো এবং শিল্পবর্জ্য সংগ্রহ, পাম্পিং, প্রক্রিয়ায়ন এবং অপসারণের জন্য পয়ঃপ্রণালি ব্যবস্থা নির্মাণ, উন্নয়ন ও সংরক্ষণ; (গ) কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় বিদ্যমান অপ্রয়োজনীয় বা অকেজো নর্দমা বন্ধকরণ বা করান; (ঘ) বৃষ্টির পানিনিষ্কাশনসহ নিষ্কাশন-সুবিধার জন্য ময়লা নির্গমন প্রণালি নির্মাণ ও সংরক্ষণ।’
ঢাকা মহানগরীর নিষ্কাশন নিয়ে গত ১৬ জুলাই ২০১৭ অনুষ্ঠিত সমন্বয় সভায় ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান এক বিস্ময়কর মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশে খাবার পানির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ড্রেন পরিষ্কার করে না’ (দৈনিক যুগান্তর, ১৭ জুলাই ২০১৭)। উল্লেখ্য, ওয়াসার কাজ শুধু খাবার পানি সরবরাহ নয়, ১৭ (২) (খ) ধারা অনুযায়ী নগরীর পয়ো এবং শিল্পবর্জ্য সংগ্রহ, পাম্পিং, প্রক্রিয়ায়ন তার কাজ। কিন্তু ওয়াসা তার ড্রেনেজ সার্কেল দিয়ে নগরীর বৃষ্টির পানিনিষ্কাশনের খালগুলোকে বক্স কালভার্ট নালায় পরিণত করেছে এবং নগরীর পয়ো ও শিল্পবর্জ্য প্রক্রিয়ায়ন না করেই সেখানে ঢেলে দিচ্ছে। এ কারণে ঢাকা নগরীর আশপাশের জলাভূমি ও চারটি নদী ওয়াসার পয়োবর্জ্য ও শিল্পবর্জ্যের ভারে চরমভাবে দূষিত হয়ে ত্রাহি ত্রাহি করছে। এই অবৈধ পরিবেশদূষণের কাজটির জন্য তাঁর প্রতিষ্ঠানই একমাত্র দায়ী। প্রকৌশলী তাকসিম এ খান আবার বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের একজন নেতা। তিনি কি জানেন না, পৃথিবীর কোনো দেশেই বৃষ্টির পানির নালায় পয়োবর্জ্য ও শিল্পবর্জ্য ফেলা হয় না। তিনি কেন পয়ো এবং শিল্পবর্জ্য প্রক্রিয়ায়নের কাজ করছেন না?
ওই সমন্বয় সভায় ঢাকা সিটি করপোরেশনের ড্রেনগুলোর ময়লা তোলার দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনকে দেওয়া হয়। সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। নগরীর সড়ক থেকে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের ওয়ার্ডভিত্তিক নালাগুলোর মুখ পরিষ্কার করা হয়তো সিটি করপোরেশন দুটি করতে পারে, কিন্তু কয়েকটি ওয়ার্ড মিলে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের বড় নালাগুলো (যেগুলো আগে বড় খাল ছিল) তারা কীভাবে পরিষ্কার করবে?
সভায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন। তিনি এই দূষণ বিষয়ে কোনো আপত্তি তোলেননি এবং ঢাকা মহানগরীর ভেতরে নরাই ও তুরাগ নদের অববাহিকার বেগুনবাড়ি খাল, ধোলাইখাল, রমনা খাল, আরামবাগ খাল, জিরানী খাল, রামচন্দ্রপুর খাল, কল্যাণপুর খাল, মহাখালী খাল ইত্যাদি ভরাট করে যে জলাবদ্ধতা তৈরি করা হয়েছে, সে ব্যাপারে কিছুই বলেননি। ঢাকা নগরীতে ৩৮টির বেশি খাল ছিল, যার মধ্যে ওই খালগুলো প্রধান। এগুলোসহ অন্য খালগুলো অবিলম্বে দখলমুক্ত ও ভরাটমুক্ত করা দরকার।
ঢাকা নগরীর জলাবদ্ধতা দূর করতে হলে বৃষ্টির পানিনিষ্কাশনের জন্য দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়া অতীতের খালগুলো উদ্ধার করে ডিজাইন মোতাবেক কেটে চওড়া করা ও উন্মুক্ত করা দরকার। ‘বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন ২০০০’-এর ৬(১)(ক) ধারায় বলা আছে, ‘নদী ও নদী অববাহিকা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানিনিষ্কাশন, সেচ ও খরা প্রতিরোধের লক্ষ্যে জলাধার, ব্যারাজ, বাঁধ, রেগুলেটর বা অন্য যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণ…’। এই আইনের ধারা ১৫ অনুযায়ী ১০০০ হেক্টরের চেয়ে বড় এলাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাদেরই দেওয়া হয়েছে। ঢাকা নগরীর ওয়ার্ডগুলো কোনো কোনোটি ১০০০ হেক্টর এলাকার কম, যেখানে নিষ্কাশন নালাগুলো ওয়াসা নির্মাণ করেছে। কিন্তু যেকোনো দুটি ওয়ার্ডের মিলিত এলাকা ১০০০ হেক্টরের বেশি, যার জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডই আইনতভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাই তাকেই এ কাজ করতে দেওয়া দরকার।
ম ইনামুল হক
বাংলাদেশ নদীগবেষণা ইনস্টিটিউট ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক
চেয়ারম্যান, জল পরিবেশ ইনস্টিটিউট।