হাতে হাতে ভিডিও, হয়রানিতে অভিভাবকরা

Kustiapronographyরিপোর্টার, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকাঃ কুষ্টিয়ার এক স্কুল শিক্ষকের যৌন নিপীড়নের ভিডিওচিত্র ছড়িয়ে পড়ার পর ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা এখন হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ভিডিওচিত্র ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটছে। নিপীড়কদের হামলায় এলাকা ছাড়তে হয়েছে একটি পরিবারকে। ঘরের ভেতরে ‘বন্দি’ জীবন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক ছাত্রী।

প্রায় দেড় মাস আগে ভিডিওচিত্রের কথা জানাজানি হলেও এখনো সেগুলো জব্দ করতে পারেনি পুলিশ। বাজারে সিডির দোকানে সেগুলো অবাধে বিক্রি হলেও পুলিশের জোরালো কোনো উদ্যোগ নেই বলে অভিযোগ অনেক অভিভাবকের।

এ ঘটনায় পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে কুষ্টিয়ার আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক হেলাল উদ্দিন পান্নাসহ চার জনকে আসামি করে গত ৭ জুলাই কুষ্টিয়া মডেল থানায় একটি মামলা করে পুলিশ।

মামলার অন্য আসামিরা হলেন- প্রকৌশলী আলিমুজ্জামান ওরফে টুটুল, প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম ওরফে সজল ও প্রকৌশলী হাসানুজ্জামান হাসান। তাদের সবার বাড়ি কুষ্টিয়ার হাটশ হরিপুর ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে।

মামলার এজাহারে বলা হয়, গত মাসে হেলাল উদ্দিন তার কাছে প্রাইভেট পড়তে আসা এক ছাত্রীর সঙ্গে জোর করে ছবি তোলার পর বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। এ নিয়ে গত ১৫ জুন ওই ছাত্রীর আত্মীয়-স্বজন, এলাকাবাসী ও কয়েকজন সাংবাদিক হেলালকে মারধর করে। তারপর থেকে পলাতক রয়েছেন হেলাল।

Kustiapronography2

ওই দিন হেলালের ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে সেগুলো এলাকার একটি কম্পিউটারের দোকানে পরীক্ষা করলে বিভিন্ন সময়ে ছাত্রী ও বিভিন্ন বয়সী নারীদের ওপর ওই শিক্ষকের যৌন নিপীড়নের ভিডিও পাওয়া যায়। এরপর সেই দোকান থেকেই শিক্ষার্থীসহ সমাজের বিভিন্ন বয়সী মানুষের হাতে ছড়িয়ে পড়ে সেইসব ভিডিও। 

চার-পাঁচ বছর আগে থেকে শুরু করে গত ১৪ জুন পর্যন্ত গোপন ক্যামেরায় এসব দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে বলে এজাহারে বলা হয়।

আসামিদের মধ্যে শুধু হাসানুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, যদিও ছড়িয়ে পড়া কোনো ভিডিওচিত্রে সরাসরি তাকে দেখা যায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

ওই সব ভিডিওচিত্রে স্থানীয় প্রভাবশালী মনিরুল ইসলাম মনো ও তার ভাগ্নে দুলাল উদ্দিনকে দেখা গেলেও মামলায় তাদের আসামি করা হয়নি।

স্থানীয়রা জানান, এক ছাত্রীর ওপর মনোর যৌন নিপীড়নের ভিডিওচিত্র ছড়িয়ে পড়ার পর দুর্বৃত্তরা ওই ছাত্রীর বাড়িতে হামলা চালায়। এরপর শহরের হাউজিং এস্টেট এলাকায় নিজেদের বাড়ি ছেড়ে অন্য স্থানে থাকতে বাধ্য হচ্ছে পরিবারটি।

শহরতলীর যুগিয়া এলাকার এক অভিভাবক বলেন, “এক লোক নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে আমার মেয়ের ভিডিওক্লিপ বাজারে ছাড়ার ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের টানা চেয়েছে।”

স্থানীয় প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানানোর পরেও আশ্বস্ত হওয়ার মতো কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন নির্যাতিত এক ছাত্রীর মা।

কান্না জড়িত কণ্ঠে এবিসি নিউজ বিডিকে ওই স্কুল শিক্ষিকা বলেন, “পান্না গংয়ের জানোয়ারদের লালসার শিকার হয়েছে আমার মেয়ে, আবার নতুন করে ওই হত্যাকাণ্ডের নৃশংস, নোংরা, অশ্লীল ভিডিওচিত্রগুলি বজারে ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে।” Kustiapronography3

এই ঘটনার বিচার হবে কি না তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।

ঘটনার শিকার হয়ে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের সম্মানের এক ছাত্রী লেখাপড়া ছেড়ে ঘরে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন।

তার বাড়িতে গেলে সাংবাদিকদের ওপরও ক্ষোভ প্রকাশ করেন ওই ছাত্রীর মা ।

তিনি বলেন, “আমার মেয়ে এখন জিন্দা লাশ। এ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। আমার মেয়ে এভাবে বদ্ধ ঘরে আটকে থেকে এক সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে। দয়া করে সেটা যাতে না হয় সেজন্য আপনারা আমাদের মাফ করে দিন।”

যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই স্কুল শিক্ষক হেলাল উদ্দিনকে সম্প্রতি তালাক দেন তার স্ত্রী স্কুলশিক্ষিকা ফাতেমা আক্তার চুমকি।

হেলাল ও তার সহযোগীদের বিচার দাবি করে তিনি বলেন, “হেলাল তার সহযোগীদের সাথে নিয়ে যে জঘন্য অপরাধ করেছে একজন নারী, মা, অভিভাবক হিসেবে আমি তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। আমি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।”

ওই সব ভিডিওচিত্র যারা ছড়িয়ে দিয়েছে তাদেরও গ্রেপ্তার করার দাবি করেন তিনি।

এ ঘটনার প্রতিবাদে এবং দোষীদের গ্রেপ্তার দাবিতে এলাকাবাসীর পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করছে।শীর্ষ কর্মকর্তাদের স্মারকলিপি দেয়ার পরেও প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন নারীনেত্রী অ্যাডভোকেট মঞ্জুরী বেগম।

ব্লাস্ট সমন্বয়ক শংকর মজুমদার বলেন, এ রকম একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রসাশন দ্রুত পদক্ষেপ নিলে এ ধরনের বিপর্যয় ঘটতো না।

এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কুষ্টিয়া মডেল থানার ওসি শিকদার মশিউর রহমান কেবল বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সোহেল রেজা বলেন, “মামলাটিকে বিশেষ গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে এর তদন্তভার গোয়েন্দা পুলিশকে দেয়া হয়েছে। এছাড়া ভিডিও ছড়ানো বন্ধে র‌্যাবের পক্ষ থেকেও পর্যবেক্ষণ চালানো হচ্ছে।

অবশ্য এ ঘটনায় পুলিশ যে সময়মতো পদক্ষেপ নিতে পারেনি, তা স্বীকার করেন এই কর্মকর্তা।

“যেদিন হেলাল উদ্দিনকে এলাকাবাসী আটক করে সেই সময়েই থানা পুলিশ তৎপর হলে পরবর্তীতে যা কিছুই ঘটেছে তার সবই পুলিশের নিয়ন্ত্রণে চলে আসত। এই অপরাধে জড়িত সবাইকে এরইমধ্যে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হতো।”

তবে শিগগিরই আসামিদের গ্রেপ্তার করা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

এ বিষয়ে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন বলেন, বিষয়টি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিবিড়ভাবে দেখা হচ্ছে। ভিডিচিত্র ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হচ্ছে।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ