বগুড়ায় রেলের সম্পত্তি আ.লীগ নেতাদের দখলে
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: বগুড়া শহরের পশ্চিম প্রান্ত ঘেঁষে প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি আজিজুল হক কলেজ। এর সামনে প্রায় এক কিলোমিটার জায়গাজুড়ে ছিল বিশাল জলাধার আর বিস্তীর্ণ মাঠ। কিন্তু এখন সবই বেদখলে।
ফাঁকা জায়গায় এখন সারি সারি দোকান, কোনোটা চালু হয়েছে, কোনোটা নির্মাণাধীন। কিছুদিন পর কলেজ ভবনটি ঢেকে যাবে এসব অবৈধ দোকানের কারণে।
কলেজটির অধ্যক্ষ মো. সামস্-উল আলম বলেন, ‘এভাবে জলাধার আর মাঠ দখল করে দোকান উঠতে থাকলে কলেজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে, পড়ালেখার পরিবেশ নষ্ট হবে। ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে এসব দখলের প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছি, কাজ হয়নি।’ তিনি বললেন, ‘ওরা রেলওয়ের কাছ থেকে জায়গা ইজারা নেওয়ার কিছু কাগজ হাতে ধরিয়ে দিল, এসব কাগজ জাল।’
শহরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই শহরে রেলওয়ের শত শত বিঘা জমি এখন বেদখলে। সিংহভাগ জমি দখল করে নিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। কেউ দখল করে মার্কেট করেছেন, কেউ দোকান। কেউবা জলাশয় দখল করে মাছ চাষ করছেন, কেউ জলাশয় ভরাট করে বিপণিকেন্দ্র নির্মাণ করছেন। এসব দখল নিয়ে রেলওয়ে যেমন কিছুই করছে না, তেমনি প্রশাসনও কিছু বলছে না।
জানা গেছে, আজিজুল হক কলেজের রোকেয়া হোস্টেলের সামনে কামারগাড়ি এলাকায় বিরাট আয়তনের লেক আকৃতির একটি জলাধার দখল করে মাছ চাষ করছেন জেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার প্যানেল মেয়র শামসুদ্দিন শেখ হেলাল। তাঁর দখলে আছে লেকপাড়ের শেখ মার্কেটের ১২টি দোকান।
দখলে পিছিয়ে নেই কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক আবু জাফর মো. মাহমুদুন্নবীও। তিনি কলেজের সামনের লেক ভরাট করে বেশ কয়েকটি দোকানঘর নির্মাণ করেছেন।
বগুড়া শহরের স্টেশন সড়কের এডওয়ার্ড পার্কসংলগ্ন এলাকায় একসময় রেল কলোনি ছিল। সাড়ে চার একরের (১৩ বিঘার বেশি) এই জায়গায় এখন মাটি ভরাট করে মার্কেট তৈরির তোড়জোড় চলছে। কারা মার্কেট করছেন জানতে চাইলে রেলওয়ের এক কর্মচারী জানান, বগুড়া শহর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আবদুল মান্নানসহ ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা মার্কেট করছেন।
জানতে চাইলে আবদুল মান্নান বলেন, জমিটি রেলওয়ে কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে ইজারা নিয়েছে বগুড়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতি। এই সমিতি দোকান নির্মাণের জন্য তাঁর সঙ্গে চুক্তি করে। চুক্তিপত্রে দেখা যায়, ১ লাখ ৯৫ হাজার বর্গফুটের এই জায়গায় ৮৫০টি দোকান করা হবে। এসব বরাদ্দও তিনি দেবেন।
সমিতির নামে মার্কেট বরাদ্দ নিলে তা নির্মাণের জন্য আওয়ামী লীগ নেতা মান্নানের সঙ্গে কেন চুক্তি করলেন— জানতে চাইলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি খাজা নাজিম উদ্দিন বলেন, হাজারী নামের এক রেল কর্মচারী এ বরাদ্দ নিয়েছেন। আর তাঁরা দোকান নির্মাণ করতে পারবেন বলে আওয়ামী লীগ নেতাকে দায়িত্ব দিয়েছেন।
শহরের রেলস্টেশন ও হাড্ডিপট্টি বাস টার্মিনালের পাশে কামারগাড়ি পুকুর নামে পরিচিত পাশাপাশি দুটি পুকুর ছিল। আজিজুল হক কলেজ ঘিরে শহরের কামারগাড়ি এলাকায় রয়েছে কয়েক শ ছাত্রাবাস। শিক্ষার্থীদের কাছে এটি লেক হিসেবে পরিচিত। বিকেলে তাঁরা সেখানে সময় কাটান। গতকাল সেখানে গিয়ে দেখা গেল, জোড়া পুকুরের একটি পুকুর ভরাট করে মার্কেট নির্মাণ চলছে।
কারা মার্কেট নির্মাণ করছে—জানতে চাইলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শ্রমিক লীগ নেতা কাউন্সিলর শামছুদ্দিন শেখ হেলাল, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মান্নান এবং যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ও ধর্ষণ মামলার আসামি তুফান সরকারের ভাই আবদুল মতিন সরকার এই মার্কেট নির্মাণ করছেন।
বগুড়ায় রেলওয়ের আইনজীবী চিত্তরঞ্জন বসাক বলেন, অবৈধভাবে এই জমি দখল করা হয়েছে। রেলওয়ের পুকুর দখলের অভিযোগে ওই তিন নেতার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই সদর থানায় মামলা করেছে রেলওয়ের ভূসম্পত্তি বিভাগ। ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিল রেলওয়ে বগুড়ার ৩ ও ৪ নম্বর কাচারীর তৎকালীন কানুনগো মো. মোকারম হোসেন মামলাটি করেন। কিন্তু মামলা করেও সুরাহা হয়নি, উল্টো আসামিরা ওই জায়গায় মার্কেট তৈরি করছেন।
জানতে চাইলে শামছুদ্দিন শেখ মার্কেট নির্মাণের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘সবই মান্নান করছে। আমাকে কিছু দোকান দিয়েছে। এর বেশি আমি জানি না।’
শহর আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল মান্নান বলেন, রেলওয়ের মালিকানাধীন পুকুরটির শ্রেণি কৃষি দেখিয়ে একজনকে ইজারা দিয়েছিল রেলওয়ে। তিনি সেই জমি বাণিজ্যিক দরে কিনে নিয়ে মার্কেট করছেন। যে জমি দখলের অভিযোগে মামলা চলছে সেই জমি কী করে রেল আপনাকে দিল? জবাবে তিনি বলেন, সেটা রেলওয়েকে জিজ্ঞেস করেন।
লালমনিরহাট রেলওয়ের বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তার (ভারপ্রাপ্ত) সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
মামলা তদন্তের ব্যাপারে জানতে চাইলে বগুড়া সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আছলাম আলী বলেন, এ মামলার ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না।
বগুড়ায় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক এ কে এম মাসুদুজ্জামান বলেন, পরিবেশ আইনে শহরাঞ্চলে পুকুর ভরাট নিষিদ্ধ। তবে পুকুরটির মালিকানা যেহেতু রেলওয়ের, তাই তাদেরই ব্যবস্থা নিতে হবে। পরে পরিবেশ অধিদপ্তর ব্যবস্থা নিতে পারে।
রেলওয়ের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন জজকোর্টের আইনজীবী চিত্তরঞ্জন বসাক। তিনি বলেন, শহরের চাষি বাজারে রেলের তিন একর জমি দখল করে মার্কেট করেছে পৌরসভা। তারা অন্যায়ভাবে এই মার্কেট ইজারা দিচ্ছে।
পৌরসভার মেয়র এ কে এম মাহবুবুর রহমান বলেন, জমি যারই হোক বাজার হলেই পৌরসভা ইজারা দেবে, সেটাই আইন।
রেলের জমি দখলে রাখার ব্যাপারে জানতে চাইলে কাহালু পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হেলাল উদ্দিন কবিরাজ বলেন, এই জমিতে মার্কেট নির্মাণ করার জন্য রেলের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। অনুমতি পেলে সেটা করা হবে। তখন মামলাও থাকবে না।
রেলের আইনজীবী বলেন, বগুড়ায় সব মিলে ২০ বিঘা জমি দখলের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা তিনি পরিচালনা করছেন। রেলের সম্পত্তি সবাই লুটপাট করে খাচ্ছে। তিনি বলেন, রেল কর্তৃপক্ষ আইনজীবীকে এক দিনের জন্য মাত্র ৩২ টাকা ফি দেয়। এর চেয়ে বেশি টাকা মানুষ ভিক্ষে দেয়।
বগুড়া জেলা ট্রাক মালিক সমিতির বিবৃতি
বগুড়া জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি আবদুল মান্নান আকন্দ গতকাল বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেন, জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, আবদুল মতিন সরকারকে যে হত্যা মামলায় পলাতক দেখানো হয়েছে, একই মামলায় আসামি শফিকুল ইসলামও পলাতক আছেন। কিন্তু পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে সেটা গোপন করা হয়েছে। এ ঘটনায় মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। যেকোনো মুহূর্তে মালিক-শ্রমিকেরা রাস্তায় নামতে পারেন বলে হুমকি দেন তিনি।