আগে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে
নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সংলাপ হয়েছে। ওই সংলাপে সেনা মোতায়েন, ‘না’ ভোট প্রবর্তন, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন দেওয়াসহ বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন তাঁরা। এ ব্যাপারে দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, সবার আগে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। পরিবর্তন করতে হবে বর্তমান নির্বাচনী সংস্কৃতির। তবেই এ-সংক্রান্ত জটিলতার স্থায়ী সমাধান সম্ভব।
একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত সোমবার থেকে সংলাপ শুরু করেছে ইসি। প্রথমেই আমন্ত্রণ জানানো হয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের। সংলাপে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা, নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো, নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা পুনরুদ্ধার করার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
সুশীল সমাজের অনেকে বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে প্রার্থী, পোলিং এজেন্ট, ভোটার—সবার মনে আতঙ্ক রয়েছে। আতঙ্ক দূর করতে সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সংলাপে না ভোটের বিধান রাখার প্রস্তাবও আসে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ আলম বলেন, ‘সেনা মোতায়েন অনেক পরের বিষয়। নির্বাচনের আগের পরিস্থিতি অনুযায়ী বোঝা যাবে যে সেনা মোতায়েন প্রয়োজন হবে কী হবে না। আমরা না ভোটের পক্ষে। একই সঙ্গে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কল ব্যাক করার ব্যবস্থাও থাকা উচিত। নির্বাচিত হওয়ার পর জনগণ যদি কাউকে অপছন্দ করে, তবে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও থাকতে হবে।’
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, ‘সামরিক বাহিনী থাকবে কী থাকবে না, তার চেয়ে বড় বিষয় হলো এটি তো যুদ্ধক্ষেত্র না। বর্তমান অবস্থায় সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না বলেই সুশীল সমাজ এই প্রস্থাব দিয়েছে। সেনা মোতায়েনের কথা যখন তারা বলছে, এর মানে হলো পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে জনগণ নিরাপদ না। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।’ না ভোট থাকার পক্ষেও মত দেন তিনি।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সমন্বয়ক সাইফুল হক বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। না ভোটের বিধান তুলে দিয়ে একটি অন্যায় কাজ করা হয়েছে। সেনাবাহিনী সাধারণভাবে আমরা চাই না। কিন্তু সরকার অনাস্থা ও অবিশ্বাসের বিষয়টি এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে সেনা মোতায়েনের প্রশ্নটি উঠছে। প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু এলাকায় স্ট্যান্ডিং ফোর্স হিসেবে সেনা মোতায়েন করা যেতে পারে। তবে এটি ইসির এখতিয়ারে রাখতে হবে।’
সংলাপে সুশীল সমাজের কেউ কেউ নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসিকে শক্তভাবে কাজ করার কথা সংলাপে উঠেছে।
গণসংহতি আন্দোলনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল বলেছেন, ইসি অনেক অর্থেই শাসক দলের ক্ষমতা দিয়ে সীমাবদ্ধ। তিনি আরও বলেন, ‘একে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন করার ব্যবস্থা নিতে হবে। ইসি গঠনে একটি সাংবিধানিক কমিশন গঠন করা দরকার। ইসির ক্ষমতার জায়গাগুলো স্পষ্ট করা জরুরি। আমরা মনে করি, এটি নির্বাচনের সময় ডি ফ্যাক্টো সরকারের কাজ করবে।’
গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। এ জন্য পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাতেই পরিবর্তন প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, ‘শ্রমিকশ্রেণি থেকে বিভিন্ন এলাকায় মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে আমরা দলে আলোচনা করেছি। কিন্তু বাধ্যতামূলক জামানতের টাকা তিনি কোথায় পাবেন? সুতরাং যাঁর শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা আছে, তাঁকেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকা উচিত। তাহলে তৃণমূল থেকে জনপ্রতিনিধি উঠে আসতে পারবেন।’ সেনা মোতায়েনের ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই বলে জানান এই নেতা।
সিইসি সম্প্রতি বলেছিলেন যে তফসিল ঘোষণার আগে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে ইসির কিছু করার নেই। সুশীল সমাজের সংলাপে অনেকে এ কথার সঙ্গে দ্বিমত জানিয়েছেন।
সাইফুল হক বলেন, পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থা যেভাবে টাকার খেলা ও পেশিশক্তির প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে, সেটি থামাতে হবে। ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ সংসদ সদস্যই এখন ব্যবসায়ী। এখানে কালোটাকার দৌরাত্ম্য যেভাবে বাড়ছে, তাতে কোনো জনদরদি রাজনীতিকের পক্ষে নির্বাচনে জিতে জনপ্রতিনিধি হওয়া অসম্ভব। এর জন্য পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন।
সংলাপে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক বা সহায়ক সরকারের বিষয়টিও আলোচনায় আসে। দু-একজন এর সরাসরি বিরোধিতা করেন। আর বিষয়টি নিয়ে ইসিকে কিছু না বলার পরামর্শ দেন কেউ কেউ। এ ছাড়া ইভিএম ব্যবহার প্রসঙ্গে কেউ কেউ বলেন, ইভিএম ব্যবহার করে নতুন বিতর্ক টেনে আনা ঠিক হবে না।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক বা সহায়ক সরকার হলো আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাওয়ার গেম। যে যখন বিরোধী দলে থাকে, তখনই শুধু চায়। সরকারে থাকলে আবার চায় না। সহায়ক সরকার একটি অস্থায়ী সমাধান। স্থায়ী সমাধানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। এর আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা বাড়াতে হবে।’
ইভিএম চালুর ব্যাপারে তিনি বলেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে আগে এটি ব্যবহার করতে হবে। মানুষকে এ ব্যাপারে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। এরপর জাতীয় নির্বাচনে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
ইসি একা কিছু করতে পারবে না মন্তব্য করে বাসদের খালেকুজ্জামান বলেন, ‘হারমোনিয়ামের সাতটি সুর আছে। সব বাদ দিয়ে শুধু সা বাজাতে থাকলে সংগীত হয় না। পুলিশ প্রশাসন, আমলাতন্ত্র, বিচারব্যবস্থা, শাসক দল, রাজনৈতিক সংস্কৃতি—সবকিছুতেই ইতিবাচক পরিবর্তন প্রয়োজন।’