৪১০০ কোটি টাকা নিয়ে উধাও

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রায় ৪ হাজার ৬৮ কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করার পর তা ফেরত দিচ্ছে না ২৬৬টি সমবায় সমিতি। এসব সমিতির বেশির ভাগ তাদের কার্যালয় বন্ধ করে পালিয়েছে।

সমবায় অধিদপ্তর সারা দেশে অনুসন্ধান চালিয়ে ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত উধাও হয়ে যাওয়া সমিতিগুলোর ওপর ওই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, নথিপত্রে থাকা হিসাবের বাইরেও প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। সদস্য ও সদস্যদের বাইরে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রে এসব সমিতির মূল কৌশল ছিল উচ্চ মুনাফার লোভ। লোভে পড়ে অনেকেই এসব সমিতিতে টাকা রাখেন। যেমন ২০০৯ সালে গ্রামীণ মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি প্রতি ১ লাখ টাকায় মাসে ২ হাজার টাকা বা ২৪ শতাংশ মুনাফার লোভ দেখিয়ে শান্তিনগরের বাসিন্দা আর হোসেনের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নেয়। এক বছর তারা ঠিকমতো মুনাফার টাকা দিলেও এরপর নিয়মিতভাবে তা দেয়নি। এখন জমা টাকাও খোয়া গেছে বলে জানান আর হোসেন।

সমবায় সমিতির উধাও হয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। সংসদীয় কমিটির সদস্য সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, এসব সমিতির বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। বহু সমিতির অস্তিত্বই নেই। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হবে।

আইন অনুযায়ী ব্যাংক ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠান আমানত সংগ্রহ করতে পারে না। সমবায় সমিতি কেবল সদস্যদের অর্থ জমা রাখতে পারে। কিন্তু এসব সমবায় সমিতি বছরের পর বছর ধরে প্রকাশ্যে উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে আমানত সংগ্রহ করে উধাও হয়ে গেছে। সরকার কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। ফলে আইটিসিএল ও যুবকের টাকা এখনো কেউ ফেরত পাননি।

ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা আছে, কোনো সমবায় সমিতি সদস্য ব্যতীত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অবৈধভাবে আমানত গ্রহণ করলে বাংলাদেশ ব্যাংক যেকোনো সমবায় সমিতি পরিদর্শন করতে এবং সমিতিকে নির্দেশ দিতে পারবে। অতীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন সময় গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে সমবায় সমিতিতে আমানত জমা না রাখার জন্য সাধারণ মানুষকে সতর্কও করেছে। কিন্তু আমানত রাখা কমেনি।

সমবায় অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে মোট সমবায় সমিতির সংখ্যা ৬৩ হাজার ৩১১টি। এর মধ্যে অভিযুক্ত ২৬৬টি সমবায়ের ২২১টি বহুমুখী সমবায় সমিতি, ২৪টি সঞ্চয় ও ঋণদান সমিতি এবং ২১টি অন্যান্য সমিতি। সমবায় অধিদপ্তর কিছু সমিতির ক্ষতিগ্রস্ত সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে সম্পত্তি উদ্ধার ও অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা নিয়েছে। এ ছাড়া সমিতির দায়ী ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) অনুরোধ জানিয়েছে অধিদপ্তর।

পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মো. মসিউর রহমান এ বিষয়ে বলেন, ‘সমিতিগুলো বড় হওয়ার পরে টাকাপয়সার ভাগাভাগি নিয়ে গন্ডগোল লাগে। এরপর একটি গোষ্ঠী টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। তখন আমাদের কিছু করার থাকে না। এ জন্য নজরদারি বাড়াতে আমরা সমবায় আইনটাই পাল্টে দিচ্ছি।’

বড় অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করেছে যেসব সমিতি

আলোচিত ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি সংগ্রহ করেছিল ১ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকার আমানত। এ নিয়ে মামলা চলছে। বাকি সমিতিগুলো সংগ্রহ করেছে ২ হাজার ৬১০ কোটি টাকার আমানত।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইডিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটি সদস্য ও আমানতকারীদের কাছ থেকে নিয়েছে ৪৪৭ কোটি টাকা। এই সমিতি আইসিএল রিয়েল এস্টেটের নামে ১৬৭ কোটি টাকার জমি কিনেছে, যা সমিতির নামে নয়। আইডিয়াল এখনো চালু আছে এবং এটি কিছু গ্রাহকের টাকার বিপরীতে জমি সমন্বয় করেছে বলে উল্লেখ করা হয় সমবায় অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে।

এ ছাড়া, ম্যাক্সিম ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি ১০৫ কোটি, প্রিমিয়ার ফিন্যান্স অ্যান্ড কমার্স মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ ৬০ কোটি, অগ্রণী কমার্স অ্যান্ড ফাইন্যান্স মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ ৪৪ কোটি, শাহজালাল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ ৪১ কোটি, এক্সিম মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ ৩৭ কোটি, ইসলামিক মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ ৩৩ কোটি, আল-আকসা ইসলামি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ ২৩ কোটি এবং মিউচুয়াল মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি ২০ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করেছে।

উল্লেখ্য, এসব সমিতিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তিন থেকে পাঁচ বছর আগে নিরীক্ষা পরিচালনা করেছে সমবায় অধিদপ্তর। ফলে সমিতিগুলোর সর্বশেষ আর্থিক চিত্র উঠে আসেনি। গ্রাহকেরা নিরীক্ষায় উল্লিখিত অর্থের চেয়ে বেশি অর্থ পাওনা বলে দাবি করছেন। যেমন উত্তরা ইনভেস্টমেন্ট মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির ১৫টি শাখা ছিল। এটিতে সর্বশেষ নিরীক্ষা হয়েছে ২০১০-১১ অর্থবছরে। ওই সময়ে সমিতিটি গ্রাহকের কাছ থেকে ৬০ কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করেছিল। কিন্তু অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে এখন বলা হয়েছে, সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সভাপতি এম মোশারফ হোসেন ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে ৫০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করা রুরাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির কার্যালয় ছিল পুরানা পল্টনে। ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে দেখা যায় তাদের কার্যালয় নেই। ভবনটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা আবিদ হোসেন বলেন, ওই সমবায় সমিতিটি তাঁদের ৭ লাখ টাকা ভাড়া বকেয়া রেখে কয়েক বছর আগে চলে যায়। এমনকি তাঁর বোনের এক কোটি টাকাও তারা মেরে দিয়েছে।

একইভাবে ভাড়া না দিয়ে চলে গেছে ৫৬ পুরানা পল্টনের শখ সেন্টার নামের ভবনের ঠিকানার জয়েন্ট ইসলামি ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি। ওই ভবনের তত্ত্বাবধায়ক মো. লিটন বলেন, বছর তিনেক আগে সমিতিটি উধাও হয়ে যাওয়ার পর গ্রাহকেরা এসে কার্যালয়ের চেয়ার-টেবিল ও অন্যান্য সরঞ্জাম বিক্রি করে দেন। কয়েক মাসের বকেয়া ভাড়াও আর আদায় করা যায়নি।

উধাও হয়ে যাওয়া সিটি ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেটিভ সোসাইটি ও ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেটিভ সোসাইটির কার্যালয় ছিল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে। ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে সেখানে তাদের পাওয়া যায়নি। একইভাবে পাওয়া যায়নি মতিঝিলের দ্য গ্রামীণ ইনভেস্টমেন্ট মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটিও।

অধিদপ্তর কর্মকর্তাদের যোগসাজশ

ঢাকাকেন্দ্রিক ও ঢাকা জেলার ৭৩টি সমবায় সমিতি গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিচ্ছে না অথবা উধাও হয়ে গেছে। উধাও হয়ে যাওয়া বেশ কিছু সমিতির শাখা ও কর্মএলাকা বৃদ্ধির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল সমবায় অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের তৎকালীন যুগ্ম নিবন্ধক (বর্তমানে সমবায় একাডেমির অধ্যক্ষ) মো. ইকবাল হোসেন দায়িত্বে থাকার সময়ে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব সমিতির শাখা ও কর্মএলাকা বৃদ্ধির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এবং আইন মেনে। পরবর্তী সময়ে সমিতির ব্যবস্থাপনা কোনো অপরাধ করলে তার দায় অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তায় না। অবশ্য বহুল আলোচিত ডেসটিনিকে অবৈধভাবে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগে ইকবাল হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলছে।

সমবায় অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের সাবেক যুগ্ম নিবন্ধক মো. আবুল হোসেনের বিরুদ্ধেও ২০১০ সালে একটি বিভাগীয় তদন্ত হয়। তদন্তে বলা হয়, তিনি ঢাকায় দায়িত্ব পালনের সময় ১২টি সমিতির কর্মএলাকা পুরো ঢাকা বিভাগ ধরে নিবন্ধন দিয়েছেন। নিবন্ধনে কোনো যৌক্তিকতা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া, তিনি ম্যাক্সিম বহুমুখী সমবায় সমিতি নামের একটি সমিতির ৩১টি বুথ খোলার অনুমতি দিয়েছিলেন, যা আইনের পরিপন্থী ছিল।

এসব বিষয়ে আবুল হোসেন বলেন, এসব সমিতি উধাও হয়ে যাওয়ার দায় অনুমোদনকারীর নয়, বরং যাঁরা পরবর্তী সময়ে তদারকির দায়িত্বে ছিলেন তাঁরাই দায়ী।

দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যোগসাজশ ছাড়া এ অপরাধ হতে পারত না এবং দীর্ঘদিন ধরে চলতেও পারত না। অনুসন্ধান করলে প্রভাবশালীদের ভূমিকাও পাওয়া যাবে। দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সমবায় অধিদপ্তরকে পুরোপুরি ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ