ভাঙা সড়কে কষ্টের যাত্রা

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: ঢাকায় আসার জন্য বগুড়া থেকে সকাল সাড়ে সাতটার বাসে উঠেছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাছিজা আলম। কথা ছিল দুপুরেই ঢাকায় পৌঁছে যাবেন। কিন্তু সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে রাত—মেয়ের পৌঁছানোর খবর আসে না। একপর্যায়ে চার্জ শেষ হয়ে তাঁর মুঠোফোনও বন্ধ হয়ে যায়। অজানা আশঙ্কায় বাড়িতে শুরু হয় কান্নাকাটি। শেষ পর্যন্ত রাত আড়াইটায় মেয়ের ঢাকায় পৌঁছার খবর পান মা। ঢাকা-বগুড়া মহাসড়ক এখন কতটা বেহাল, তা বোঝাতে নাছিজার পরিবারের এই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানালেন তাঁর এক প্রতিবেশী।

ঢাকা থেকে বগুড়ার সড়কপথে দূরত্ব ১৯০ কিলোমিটার। গুগল ম্যাপে বাসে এই পথ পেরোনোর সময় দেওয়া আছে পাঁচ ঘণ্টা। এই পথে নিয়মিত চলাচলকারী এক পরিবহনশ্রমিক বললেন, বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ার আগে ঢাকা থেকে বগুড়ায় যেতে বড় জোর ছয় ঘণ্টা লাগত। এখন লাগছে কমপক্ষে নয় ঘণ্টা। তিনি বলেন, সড়কের যে অবস্থা, তাতে আসন্ন ঈদুল আজহার সময় পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। আর বৃষ্টি হলে তো রক্ষা নেই।

সরেজমিনে দেখা গেছে, এই ১৯০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ১০০ কিলোমিটারের বেশি সড়ক ভাঙাচোরা। এর মধ্যে কিছু এলাকা প্রায় যানবাহন চলাচলের অযোগ্য। মূলত খানাখন্দ, সেতু সংস্কার, চার লেনের চলমান কাজের পাশাপাশি দুর্বল সড়ক ব্যবস্থাপনার কারণে দুর্ভোগ হচ্ছে।

ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল হয়ে এলেঙ্গা পর্যন্ত দূরত্ব ৯৪ কিলোমিটার। এই সড়কের চন্দ্রা মোড় থেকে এলেঙ্গা বাজার পর্যন্ত চার লেনের কাজ শুরু হয়েছে। ২০১৮ সালে এই কাজ শেষ হওয়ার কথা। এই কাজের কারণে এ পথ সরু হয়ে গেছে। গত শনিবার দেখা যায়, এই পথে ঢাকার নবীনগর ছাড়ার পর বিড়ম্বনা শুরু হচ্ছে। চন্দ্রা মোড়ে উড়ালসড়কের কাজ চলছে। এ কারণে এক পাশ বন্ধ। যে পাশ খোলা আছে, সেখানে বসেছে কাঁচাবাজার। এতে করে যানবাহন চলাচলের পথ আরও সরু হয়ে গেছে। বাইপাইল থেকে একটু এগোলে কালিয়াকৈর সেতু। পুরাতন সেতুর পাশে নতুন সেতু হচ্ছে। নির্মাণের সরঞ্জাম রাস্তার একপাশে রাখা। তাই গাড়ি আর চলতে পারছে না।

টাঙ্গাইল সড়ক বিভাগ সূত্র জানায়, ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার। এর মধ্যে মির্জাপুরের গোড়াই থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত টাঙ্গাইল জেলার অংশ ৬৫ কিলোমিটার। বাকিটুকু গাজীপুর ও ঢাকা জেলার অংশে।

টাঙ্গাইল অংশ সম্পর্কে টাঙ্গাইল সড়ক ও জনপথের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী নূর-ই-আলম বলেন, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের টাঙ্গাইল অংশে রাস্তায় তেমন সমস্যা নেই। এই বৃষ্টিতে বিশেষ করে ঈদ সামনে রেখে রাস্তায় যে ছোটখাটো খানাখন্দ ছিল, তা মেরামত করা হয়েছে। যান চলাচলে যাতে কোনো সমস্যার সৃষ্টি না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখে সড়ক বিভাগ ও চার লেন প্রকল্প যৌথভাবে কাজ করছে।

টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে মির্জাপুরের গোড়াই পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে কালিহাতীর এলেঙ্গা, দেলদুয়ারের নাটিয়াপাড়া, মির্জাপুরের জামুর্কি এলাকার প্রায় সর্বত্র খানাখন্দ। মির্জাপুর থেকে পাকুল্যা পর্যন্ত সামান্য ভালো। বাকি সব পথ ভাঙাচোরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, এই মহাসড়কে চার লেন প্রকল্পের অনেক স্থানে মাটি ভরাটের কাজ হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও সুরকি বিছানো হচ্ছে। ওই সব এলাকায় যানবাহন চার লেনের নির্মাণাধীন অংশ ব্যবহার করতে পারছে। এতে করে একসঙ্গে অনেক যানবাহন এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেতুগুলোর মুখে গিয়ে সব জটলায় পড়ছে। কারণ একটি সেতুরও নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। সেগুলো এখনো দুই লেনেই রয়েছে। মির্জাপুরের ধল্লা ও আছিমতলা এবং কালিহাতীর এলেঙ্গা সেতুর কাছে এই দৃশ্য দেখা গেছে।

আবদুল আলী নামের এক বাসচালক বলেন, আগে এই সড়কের জট এড়াতে অনেক যানবাহন টাঙ্গাইল-দেলদুয়ার হয়ে আরিচা সড়কে গিয়ে উঠত। এতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানবাহনের চাপ কমত। কিন্তু গত মাসে দেলদুয়ারের সরাতৈল ও চরপাড়ায় দুটি সেতু ভেঙে যাওয়ায় ওই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

ঢাকায় একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত টাঙ্গাইল শহরের বিশ্বাস বেতকার অধিবাসী শামীম হাসান বলেন, স্বাভাবিক অবস্থায় ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল আড়াই ঘণ্টায় পৌঁছানো যেত। এখন সেই পথে লাগছে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা।

বঙ্গবন্ধু সেতুর টোলের দায়িত্বে থাকা এক কর্মচারী বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর এই সড়কে প্রতিদিন হাজার তিনেক যানবাহন চলাচল করত। এখন স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ১২ হাজারের ওপরে যানবাহন চলাচল করে। সর্বশেষ গত ঈদে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ২৭ হাজার পর্যন্ত যানবাহন চলাচল করেছে।

হাইওয়ে পুলিশের গোড়াই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খলিলুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও চলতি পথে হঠাৎ কোনো গাড়ি বিকল হয়ে গেলে সড়ক অচল হয়ে যায়।

ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের সিরাজগঞ্জ জেলার অংশে (বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড় থেকে চান্দাইকোনা) প্রতিদিনই কমবেশি যানজট থাকছে। রোববারও এই সড়কের পাচলিয়া থেকে সাহেবগঞ্জ বাজার পর্যন্ত (১০ কিলোমিটারে) প্রায় দুই ঘণ্টা যানজট হয়েছে।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ সিরাজগঞ্জের নির্বাহী কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের সিরাজগঞ্জ জেলার আওতায় বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পার থেকে বগুড়া জেলার সীমান্তবর্তী চান্দাইকোনা পর্যন্ত ৩৯ কিলোমিটার সড়কটির বেশির ভাগ এলাকায় অসংখ্য খানাখন্দ। বিশেষ করে হাটিকুমরুল থেকে চান্দাইকোনা পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার সড়কে যানবাহন চলছে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার গতিতে। গত ঈদুল ফিতরের সময় সড়কের নলকা ও রয়াহাটি সেতু দুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন সেতু দুটি মেরামত করা হচ্ছে। ফলে একটি করে গাড়ি পার হচ্ছে। এতে করে পেছেনে যানবাহনের সারি দীর্ঘতর হচ্ছে। এ ছাড়া হাটিকুমরুল গোলচত্বরের পূর্ব দিকে ধোপাকান্দি সেতু পর্যন্ত ৪০০ মিটার এবং গোলচত্বর থেকে চান্দাইকোনা পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার অংশের বিভিন্ন স্থানে মেরামতকাজ শুরু হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, চান্দাইকোনা থেকে ভূইয়াগাতী পর্যন্ত নয় কিলোমিটার অংশের খানাখন্দে কার্পেটিং করে মেরামত চলছে। বাকি আট কিলোমিটার সড়কের হাটিকুমরুল, করমজা, সাহেবগঞ্জ, দাদপুর, ঘুরকা বেলতলা এলাকার বিভিন্ন অংশে কার্পেটিং তুলে ফেলে ইট বিছানার কাজ শুরু হয়েছে। করমজা, দাদপুর ও সাহেবগঞ্জ এলাকায় ইট বিছানোর ফলে এক লেন দিয়ে যানবাহন চলাচলের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। মহাসড়কের ধোপাকান্দি এলাকায় হাজী পেট্রোল পাম্প থেকে হাটিকুমরুল পর্যন্ত এলাপাতাড়িভাবে গাড়ি রাখায় দুই লেনের হেঁটে চলাও কঠিন হয়ে পড়েছে।

হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাদের জিলানী বলেন, এ পথে চালকেরা ওভারটেক করে যানজট তৈরি করছেন।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের সিরাজগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, সড়ক মেরামত শুরু হওয়ায় কিছুটা যানজটের সৃষ্টি হলেও চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানোই মূলত যানজটের কারণ। তিনি বলেন, এই সড়কের মেরামতকাজ ঈদের আগেই শেষ হবে।

সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেক বগুড়া শহর পর্যন্ত দূরত্ব ৬৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ২৫ কিলোমিটার বেশি খারাপ। রয়াহাটি থেকে ঘুরকা পর্যন্ত কিছু চলাচলের যোগ্য হলেও বাকি পথে চলা বেশ কষ্টকর। পুরো পথই খানাখন্দে ভরা। এই অংশে ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কারকাজ চলছে। কিন্ত বর্ষার কারণে বিটুমিনের কাজ করা যাচ্ছে না বলে ঠিকাদারেরা জানিয়েছেন।

জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, এখন মহাসড়কের যেসব জায়গায় যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে, সেসব জায়গায় সওজের নিজস্ব লোকবল দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে মেরামত করা হচ্ছে। বর্ষা চলে গেলে সংস্কারকাজ পুরোদমে করা হবে। তবে এই ঈদে মানুষ নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরতে পারবে কি না, তা তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি।

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ