সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের স্বচ্ছতা নেই

নিউজ ডেস্ক, এবিসি নিউজ বিডি, ঢাকা: ষোড়শ সংশোধনীর রায় সম্পর্কে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেছেন, বাংলাদেশ এখন আর জনগণের প্রজাতন্ত্র নয়, বরং এটা বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে। তিনি মনে করেন, ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে দেওয়া ওই রায় ছিল পূর্বধারণাপ্রসূত ও আগে থেকে চিন্তাভাবনার ফসল।

আজ বুধবার বিকেলে আইন কমিশনের কার্যালয়ে ডাকা এক সংবাদ সম্মেলনে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এসব কথা বলেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন আইন কমিশনের সদস্য বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর ও প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা ফউজুল আজিম। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আইন কমিশনের পক্ষ থেকে কথা বলতেই এ সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়েছে। শুরুতেই কমিশনের প্রধান বলেন, ‘এই রায়ে ইস্যু এড়িয়ে এত অত্যধিক পর্যবেক্ষণ রয়েছে যে আমার মনে হয়েছে মূল ইস্যুটাই হারিয়ে গেছে। প্রথমে যখন পড়তে আরম্ভ করলাম, তখন মনে হলো আমি (ভারতের বিচারক) এস নরিম্যানের অটোবায়োগ্রাফি টাইপের কিছু পড়ছি কি না। রায়ের সাত নম্বর পাতায় গিয়ে আমি বুঝতে পারলাম, এটা কোনো আপিল। এর আগে বোঝাই যাচ্ছিল না কোন বিষয় নিয়ে জাজমেন্ট দেওয়া হয়েছে। পাতার পর পাতা বিভিন্ন ধরনের অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য করা হয়েছে। রায়ের কলেবর বৃদ্ধি ছাড়া যার আর কোনো প্রয়োজন ছিল বলে আমার মনে হয় না।’

বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, সংসদ ও নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে এখানে অনেক অ্যাডভার্স (বিরূপ) বক্তব্য রাখা হয়েছে। অথচ এখানে স্পিকার বা নির্বাচন কমিশন কোনো পক্ষ ছিল না। কাজেই যাদের পক্ষ করা হয়নি তাদের অবর্তমানে তাদের সম্পর্কে এ রকম অ্যাডভার্স কমেন্ট করা বাঞ্ছনীয় নয়।

বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, রায়ের এক জায়গায় সাংসদদের ইমম্যাচিউর (অপরিপক্ব) বলে ক্রিটিসাইজ করা হয়েছে। একটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আরেকটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে এভাবে বলবে, এটা ঠিক না। চিফ জাস্টিস যদি বলেন, সংসদ সদস্যরা যদি ইমম্যাচিউরড, তাহলে আমাকে বলতে হয় সুপ্রিম কোর্টের জজ সাহেবরাও তা-ই। কারণ তাঁরা তাঁদের রায়ের মধ্যে যেসব কথাবার্তা বলার কোনো প্রয়োজন ছিল না, তা বলেছেন। যেটা বলার ফলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগকে এক্সপাঞ্জ পর্যন্ত করতে হয়েছে। এটাতে প্রমাণিত হয়, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের ইমম্যাচিউরিটি। আমরা যদি পরস্পরকে সম্মান করতে না শিখি, একে অন্যের প্রতি যদি আনপার্লামেন্টারি ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করি, যাঁরা এসব বলছেন, এগুলো সবারই ইমম্যাচিউরিটি প্রমাণ করে।’

বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, ‘জাজমেন্টের ২২৩ ও ২২৪ পাতায় বলা হয়েছে, এমপি হওয়ার আগে বিবেচনা করা উচিত, তাঁরা এমপি হওয়ার যোগ্য কি না। এখন এমপি হওয়া যোগ্য কি না সেটা ভোটাররা বুঝেছে, যারা ভোট দিয়ে তাদের এমপি বানিয়েছে। এখানে তো সুপ্রিম কোর্টের এ ধরনের মন্তব্য মেনে নেওয়া যায় না। যদি এখন এমপি সাহেবরা উল্টো বলেন, হাইকোর্টের জাজরা বিচারপতি হওয়ার যোগ্য কি না, এটা বিবেচনার দাবি রাখে, তখন কেমন শোনা যাবে। কথায় তো কথা বাড়ে। এ ধরনের অপ্রাসঙ্গিক কথা কেন সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে আসবে?’

সংসদ খুবই কার্যকর রয়েছে
বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, ‘রায়ের ২২৮ পাতায় তিনি বলছেন, সংসদ অকার্যকর (ডিসফাংশনাল)। এটাও তো সঠিক কথা হলো না। সংসদ খুবই কার্যকর রয়েছে। তাঁরা বিল পাস করছেন, বিচারপতিদের বেতন-ভাতা পাস করছেন। সব কাজই তো করছেন। তাহলে কেন এ কথাটি বলা হলো?…এ সমস্ত কথায় বরং বিচারকদের অপরিপক্বতা প্রকাশ পায়।’ এই রায় ‘পূর্বধারণাপ্রসূত’ উল্লেখ করে খায়রুল হক বলেন, ‘আমরা দুর্ভাগ্যজনকভাবে লক্ষ করেছি এই রায় হওয়ার আগে, এটার শুনানির আগে থেকে অনেক বিচারপতি বিভিন্ন সেমিনারে, অনুষ্ঠানে সাংসদদের সম্পর্কে অনেক মানহানিকর মন্তব্য করেছেন। তাহলে তো বলা যায় এই রায় এবং শুনানি সবই পূর্ব অনুমিত। এগুলো আগে থেকেই চিন্তাভাবনা করে করা ছিল। এগুলো বলার জন্য তো শুনানি করা লাগে না। তাঁর মনের মধ্যেই এসব ছিল। এটা আর যা-ই হোক, ভালো বিচারকের আচরণ বলে আমাদের কাছে মনে হয় না।’

সাবেক প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বারবার বলা হয়েছে সাংসদেরা স্বাধীন নন। সংবিধানের ৭০ ধারা তাঁদের স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে। এ কারণেই যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা তাঁদের হাতে থাকা উচিত নয়, যাঁরা নিজেরাই স্বাধীন নন। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সাংসদেরা স্বাধীন। কারণ ৭০ ধারায় বলা আছে, কোনো সাংসদ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না। যদি দেন তবে তাঁর সদস্যপদ বাতিল হবে। সংসদে ভোটাভুটিটা কিন্তু কোনো দলের পক্ষে-বিপক্ষে হয় না। সেটা হয় খসড়া বিলের পক্ষে-বিপক্ষে। একবারই দলের পক্ষে-বিপক্ষে হতে পারে, যখন নো কনফিডেন্স মোশন থাকে। সে ক্ষেত্রে ৭০ ধারার কথা আসে।’

বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করার একটা কারণ বলা হচ্ছে, এটা সংবিধানের বেসিক ফিচারকে (মৌলিক কাঠামো) খর্ব করেছে। বেসিক ফিচার ও স্ট্রাকচার হলো সংবিধানের এমন অনুচ্ছেদ, যেটা সংশোধন করলে সংবিধানের অস্তিত্ব নাড়া দিয়ে যাবে। যেমন রাষ্ট্রের চরিত্র গণপ্রজাতন্ত্রী। কিন্তু সংবিধানের সেই ধারাটি যদি বেসিক স্ট্রাকচার হয়ে থাকে, তাহলে কেউই এটা বদলাতে পারবে না। সংসদও না।

সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সে রকম সম্পর্ক নেই
বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, ‘আমার বক্তব্য পরিষ্কার, সেটা হলো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সে রকম কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এটাকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মোড়কে হাতিয়ার হিসেবে করা হচ্ছে। কারণ প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেকটা কর্মচারীর দায়বদ্ধতা আছে, কারও না কারও কাছে দায়বদ্ধতা আছে। জনগণ এ প্রজাতন্ত্রের মালিক এবং সার্বভৌম। সার্বভৌম জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে সংসদ। সবারই যখন সংসদের মাধ্যমে জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা আছে, তখন বিচারপতিদের তো সেটা না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। সেটাই ছিল বাহাত্তরের সংবিধানের ৯৬ ধারায়। ষোড়শ সংশোধনীতে আবার এই ৯৬ ধারাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এখন এটাকে অবৈধ ঘোষণা করা হলে আর দায়বদ্ধতাটা কোথায় রইল?’

বিচারকেরা জনগণের কাছে আর দায়বদ্ধ থাকছেন না
বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, বিচারকেরা জনগণের কাছে আর দায়বদ্ধ থাকছেন না। আমরা এতকাল জেনে আসছি এটা পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ। কিন্তু এ রায়ের পরে আমাদের তো মনে হচ্ছে উই আর নো লংগার ইন দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ, উই আর রাদার ইন দ্য জাজেস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ (আমরা এখন আর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে নেই, বরং বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে রয়েছি বলা যায়)। কারণ জনগণ তো সরে গেল এখান থেকে। ৯৬ ধারার মাধ্যমে জনগণের প্রতি বিচারকদের যে দায়বদ্ধতাটা ছিল, তা তো সুপ্রিম কোর্ট সরিয়ে দিল।’

বিচারপতি খায়রুল হক আরও বলেন, ‘ওনারা ধারণা করেন (বিচারকদের অপসারণের) এই ক্ষমতা জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে দেওয়া হলে ক্ষমতার অপব্যবহার হতে পারে। কিন্তু এটা একটা ধারণা মাত্র। কেউ এখনো পর্যন্ত দেখাতে পারেননি যে ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে, বা ওনারা (সংসদ) অন্যায় কিছু করেছেন বা ঠিকমতো করতে পারেননি। আমাদেরও তো ধারণা হতে পারে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলেও ঘাটতি থাকতে পারে। এটা ইমপারশিয়াল (নিরপেক্ষ) না-ও থাকতে পারে। নানা সমস্যা হতে পারে। একজন বিচারকের বিরুদ্ধে অনৈতিক আচরণের অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে কী রায় হয়েছে, তা দেখিনি। কারণ এটা প্রকাশ হয় না। এ রকম একটা অস্বচ্ছ বডি (প্রতিষ্ঠান) থেকে যদি সংসদের হাতে এ ক্ষমতা থাকত, তাহলে খুব ভালো হতো। যেখানে হাস-হাস (চুপ করিয়ে দেওয়ার প্রবণতা) জিনিস হয়ে থাকে, সেখানে স্বচ্ছতা না থাকার সম্ভাবনা বলে মনে করি।’

Leave a Reply

Facebook
ব্রেকিং নিউজ